মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ লাই

পীযূষকান্তি বিশ্বাস




দীপঙ্কর দত্ত দিল্লিতে অনেকদিন থেকেই নেই । কোথাও উধাও হয়ে গেছেন । তার কবিতা আছে, দিল্লি হাটার্স আছেন, অথচ তিনি আর নেই । হয়তো বা আছেন অথবা থাকবেন না এমনটাই ।  মে অলওয়েজ ইনক্লুড মে নট । সম্ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে সত্য । যখন ঘটে যায়, সত্যের জয় হয় । যা ঘটে না, তা সম্পূর্ণ সত্য নয় । যা হয়না , অথবা হয় , না ইধারকা না উধারকা তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা নয় । কিছু তার মিথ হয়ে থাকে,  দীপঙ্কর দত্ত বেঁচে নেই । সত্য । দীপঙ্কর দত্ত বেঁচে আছে । মিথ্যা । দীপঙ্কর দত্ত চুপ হয়ে গেছে । মিথ । আমার সঙ্গে ওর দীর্ঘদিনের কবিতা যাপন ও বইমেলা সফর , আমার কবি হতে চাওয়ার মূল ইনপাইরেশন ওনাকে জুড়েই । বন্ধু হিসাবে আমার দুচার কথা থেকে যায় । দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে দীপংকর দত্ত পাওয়ার পোয়েট্রির মতো নিজেকেই বারবার এক্সপেরিমেন্ট করেছে । আমি সাক্ষী থেকেছি । শূন্যকাল জুড়ে তার বিস্তার আর সমগ্র কবিতার মধ্যে তার কাব্যপ্রতিভা নিয়ে এই অধিক্রান্ত সময়ের পক্ক হয়ে আসা নিয়েই আজকের সত্য মিথ্যা ও মিথের কাহিনী ।  

দিল্লি হাটেই আলাপ কবি দীপঙ্কর দত্তের সঙ্গে । দুই ঋতুর দেশ । এক্সট্রিম গরম আর এক্সট্রিম ঠান্ডার তরতম্যে যা আবহাওয়া, ভাষা, সংস্কৃতি , খাদ্য, দিন যাপন, আপাত বঙ্গদেশের থেকে বিলকুল আলাদা । রাজমা চাবল আর বটটা বড়ার দিল্লি ।  গ্রীষ্ম আর শীত ছেড়ে দিলে এখানে শরৎ বলতে বুঝি শরৎকুমার চট্টোপাধ্যায় আর হেমন্ত বলতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । ভৌগলিক ভাবে তাই তার সাহিত্যদর্শন আলাদা, সকল দেশের রাণী বাংলাদেশ থেকে জারা হাটকে এই আমআদমীর দিল্লি, আর দূরে দূরে গ্রাম দশবারো খানি মাঝে একখানি হাট বলতে যা বুঝি তার থেকে হিসাব মেলে না দিল্লি হাটের । ডিফারেন্ট । এখানে মেলা লেগে আছে সারা বছর, ব্যবসা, বিদেশী খরিদ্দার । খদ্দর, চামড়া, পোড়া মাটি, এথনিক রকমারি দ্রব্যের পসার । সময়টা কোন জানুয়ারীর মাঝামাঝি,  আমি তখন তালমিল মিলিয়ে, লেফট রাইট লেফট রাইট চেনা অচেনা ফ্রেন্ডদের ট্যাগ করে করে ফেসবুকে কবিতা লিখি । ভারতীয় বায়ুসেনাতে ছিলাম । কবিতাগুলি সেই যাপনের কথা থাকতো । আমার দুনিয়া ছিল পশ্চিমদিল্লির পালাম, মহাবীর এনক্লেভ, দ্বারকা, উত্তম নগর, জনকপুরী অঞ্চল ঘিরে । সাহিত্যিক বলতে বুঝি দিলীপ বন্দোপাধ্যায়, স্বপ্না ব্যানার্জী, জয়শ্রী রায় , গোপাল চন্দ্রপাল । পত্রিকা বলতে বুঝি কথাঞ্জলী ও প্রতিভা পথিকৃৎ । একদিন দ্বারকার কবি জয়শ্রী রায় আমাকে কবিতা পড়ার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে এলেন দিল্লি হাট । নিম গাছের নীচে জমিয়ে বসে আছে বিজলী গ্রীলস । পাথুরে টেবিল, গরম কফি হাতে দিল্লি হাটার্স দুই কবি দীপঙ্কর দত্ত ও কবি দিলীপ ফৌজদার । আরবল্লী পাহাড়ের এমন দুই ধুরন্ধর কবিদের সামনে আমি এইরকম একটি কবিতা পড়ে শোনাই ।

“সালামী সাজে স্যালুট করলে / দিগ্বিজয়ী রাইফেলও আকাশ দেখতে পায় /নতমস্তক চেয়ে থাকে পামীর মালভূমি ।“

চুপ করে শুনে গেলেন, দুজনই । কুশল বিনিময় হলো । ফোন নাম্বার বিনিময় হলো ।  পরে দেখা হবে গোছের কিছু কথা ।  দিল্লি হাটার্স খুব মান্য একটি সাহিত্য গ্রুপ । আর আমি একজন অতি সামান্য । সেই ১৯৯৮ থেকে দিল্লি আছি, কিন্তু কোনদিন কবিতা নিয়ে কোথাও ধামাকা গোছের কিছু করিনি । কোথাও পৌঁছানো হয়নি । বলা যায়, স্লিপিং সেল । দিল্লি হাটার্সদের কবিতা আমার মাথার উপর দিয়ে যায়, আমি তখন ওদের কবিতা বোঝা যায় না দূরে দূরে থাকি আর দিল্লি হাটার্স ও আমার মত কবির ধার ধারে না । তখন সমসাময়িক কবিতা সম্পর্কে এত প্যাশন জন্মায়নি । সুতরাং কবিতা কি হবে আর কি হবে না, তা অস্পষ্ট ধারনা নিয়ে কবিতা চর্চা । কবিতায় একটা সততা থাকবে তায় বুকে ভয় ভয় নিয়ে মুখ লুকাই । লিখি, কি যে লিখি । দুলাইন লিখে বারবার কাটাকুটি করি, আমি জানতাম আমার কবিতার একটা মাত্রার ফলসহুড আছে, ফাঁকিও হতে পারে, আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য একটু কুণ্ঠিত থাকতাম,  আর এই কবিতাটা আদৌ কোন কবিতা হলো কিনা জানতাম না । বিচক্ষন কবি দিলীপ ফৌজদার ধরেও ফেললেন, পরিষ্কার বলে দিলেন, “নতমস্তক হয়ে উপরে তাকানো যায় না , পামীর মালভূমি তো অনেক উপরের কথা” ।  নতমস্তক হয়ে পায়ের দিকেই তাকানো যায় ।  সত্য মিথ্যার এই মোড়ে ধরা পড়ে গেলাম । বার বার কেন যে কবিরা বিনয়ী হয় ? ঘাড় পেতে মেনেও নিলাম যে আমাকে কিছু ঠিক করতে হবে । এ পর্যন্ত কিছু ফ্রুটফুল হলো না । পরিচয় ও যেন সম্পূর্ণ হোলো না ।  নাহ , দাঁড়ালো না ব্যাপারটা । ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরলাম । রাতে হটাৎ জয়শ্রীদির ফোন । “আরে পীযূষ, দারুন ব্যাপার । দীপঙ্কর তোমাকে খুব পছন্দ করেছে । দারুন উচ্ছসিত । তোমার কবিতা শূন্যকালে ছাপতে চায়” । জয়শ্রীদি পরিচয় করানোর ক্রেডিটও নিতে চাইলেন আর আমিও তা দিলাম । সি স্টুপস টু কনকুইয়ার । যুদ্ধবিরতির যে মিথ আমি কবিতায় বোঝাতে চেয়েছিলাম, দীপঙ্কর দত্ত বুঝলেন বা বুঝলেন না, কিন্তু আমি বুঝলাম আমার এই ‘আর্মি মার্কা’ মেটাফর বিক গয়া । প্যাকেজ সেলস ।  এই প্রথম মিথের সামনে মিথ্যার মনিহার গলায় জুড়ে বসলো । আমি একটা কবিতা ছাপার জন্য দিলাম শূন্যকালে । সেই থেকে দীপঙ্কর দত্ত আমার ফ্রেন্ড ফিলোজফার ও গাইড হয়ে গেলেন ।


নানান রকম মোচড়, বাক্য বিনিময়, চটকদার খবরাখব,  চমকপ্রদ খোলসা নিয়ে আমাদের মত বিনিময় হতো । বাংলা কবিতার অচেনা বাক এবং বাক্যের বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে কবি দীপঙ্কর দত্তের সংগে আলোচনা ঘন্টার পর ঘন্টা চলতো । সেগুলো কিছু মৌখিক আলোচনা, ফোন কল ও ফেসবুক চ্যাট । বাংলা লিটল ম্যাগ, দিল্লি হাট, দিল্লির বাংলা সাহিত্যের হালচাল, কিছুটা গেম থিয়োরী নিয়ে মিথ্যা থেকে কিছু সত্যে উপনিত হবার বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট । সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট নৈবর্তিক নয়, বা বলা যায় এর কোন বানিজ্যিক অভিপ্রায় ছিলো না, বরং বলা যায় যে সব ঘটনার বিবরন যা আমি আজ লিখছি তা আমার দীর্ঘদিন দীপঙ্কর দত্তের সাথে একসঙ্গে কাটানোর একান্ত অনুভূতি । এর কোন প্রমান বা তথ্য দস্তাবেজ আমার কাছে নেই ।


মিথ্যা নিয়ে আপাত নজরে এক্সপেরিমেন্ট করা যায় কিনা, বা কোন নতুন কিছু আলো বা অন্ধকার নির্গত করে কিনা তাই নিয়ে বিস্তর আলোচনার স্কোপ রয়েছে । কবি দীপঙ্কর দত্ত আমার থেকে বয়সে চোদ্দ বছরের বড় আর কাব্যজগতে কয়েক দশক সিনিয়র ছিলেন । কিন্তু আমাদের আলোচনা, কথাবার্তার মধ্যে ‘ইগো’ বলে কিছু ছিলো না । আমাকে বরং উনি অনেকটা স্পেস দিতেন, তুই তুকারি কোনদিন করেন নি ।  আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা হতো  । আমি কথোপোকথন সাহিত্যকেন্দ্রিক রাখতাম, ব্যক্তিগত ভাবে সে কি ভাবে থাকে,  কটা বাচ্চা, বৌ আছে কিনা , কে তার বর্তমান প্রেমিকা, তার ভাই কারা , মামা কোথায় থাকে এই সব প্রশ্ন আমি করতাম না । দিল্লিতে ওর অনেক কবিবন্ধু ছিলো জেনেছি তাদের সাথে ওর ঐ আলোচনা হতো । উনি যতটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন, ততটাই জিজ্ঞাসা করতাম, ততটাই শুনতাম । অনেক কথা আমি ইন্টারপোলেট করে নিতাম আর কাহিনীটা নিজের মত করে সাজিয়ে নিতাম । কিছু কিছু আলোচনা আদর্শগত হতো, কিছু কথা কাটাকাটিও হতো কিন্তু তা সামান্য মাত্রায় । প্রায়ই আমাকে মদ খেয়ে কবিতা লেখার কথা শোনাতেন, আমি কবিতাটা অবচেতনা বা অতিচেতনার জায়গা থেকে লেখার চেষ্টা করতাম না । এটা আমার কাব্যদর্শন ছিলো না, আমি রুট-কজ এনালাইসিস ও তার ব্যাক ট্রেইলে বিশ্বাসী ছিলাম । রিভার্স ইঞ্জিইয়ারিং । আমার সাহিত্য জ্ঞান সর্ব্যব্যাপী নয়, তাই আমার ধারনা ছিলো না বা এখনো নেই যে এই কাব্যদর্শন নিয়ে আজও কোন বাঙ্গালী কবিতা লিখেছেন কিনা । কবিতায় আমার এই এক্সপেরিমেন্টের কথা দীপঙ্করদা প্রথম আইডেন্টিফাই করেন । এবং নিজেই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন । নানান রকমের টিপস দেন । শিল্পের বিভিন্ন রসের কথা, ডাইমেনশনের কথা, বিষয়ভিত্তিক কবিতার কথা, ক্রিয়াপদের কথা । যেটা বেশী করে মনে পড়ে সেটা হলো  যে “কবিতা একটু ডাইরেক্ট হয়ে যাচ্ছে, একটু সাংকেতিক করো , ক্রাইম পেট্রোল দেখো, মদ খাও, মনকে বিষিয়ে তোলো ।  বিষয় নিয়ে অত ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠো না” ।  এই সত্য, মিথ্যা আর কাব্য দর্শন নিয়ে নানান রকম কথা আর কি ।  কিছু তার আমি আগ্রি করি, কিছুটা ঘাড় নাড়ি, আর কিছুটা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই । ক্রমাগত এইসব ফিল্টার প্রোসেসের মধ্যদিয়ে যাওয়াও আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট হয় ।

দীপঙ্কর দাকে এই ভাবে আবিষ্কার করছি দিন দিন । আমি কোন পন্ডিত নই, তাকে চেনাও সম্পূর্ণ নয়, শুধু বিস্ময়ে চেয়ে থাকা এক কবিতা, যেখানে বিপন্ন হতে চায় বোধ আর আত্মসমর্পন করতে চায় মিথ । যে কোন আপাত সত্যের কাছে আমি একটা প্রশ্ন নিয়ে আসি, দীপঙ্করদা এমন একটা মেটাফর নিয়ে আসেন, একটা ব্যঞ্জনা তৈরী হয়,  সেটা মিথ না মিথ্যা সেই প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি । দীপঙ্করদার গুরুবাজীতে কোন উৎসাহ ছিলো না । বরং হাতে ধরে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে ভোদকার বোতলে জল মেশাতে হয় । বলেন “মাল টানো । নিজেকে হিংস্র করে তোলো । চেতনাকে রাইড করো, তোমার মধ্যে একটা পশু আছে তাকে জাগিয়ে তোলো ” । কোন নতুন লেখা কবিতা নিয়ে এসে দেখালে বলতেন “কি করেছো হে ? লেখায় স্পীড ব্রেকার আনো” । কবিতার প্রবাহমানতা একটা মিথ  । “কবিতাকে দোমড়াও , মোচড়াও, নতুন ডাইমেনশন আনো । ভাষাকে ডিসটর্ট করো । নতুন মেটাফর আনো ” । নব রসের মধ্যে কম জনপ্রিয় একটি উদ্ভট রস । তাকে নিয়ে বাংলায় কবিতা কারা কারা কী কী লিখেছেন আমার ভালো জানা নেই, কিন্তু সাহিত্যের এই যে এক অনন্য সাধারন রস যা নিয়ে দীপঙ্করদা দিনের পর দিন একান্তে কাজ করে গেছেন তা নান্দনিক ভেতো বাজার সদানন্দে কোনদিন গ্রহন করেন নি , আর ক্যাতক্যাতানো ঘিনঘিনে গোবিন্দপুরের বাসিন্দারা কালকাজীর ভাষা বুঝে উঠতে পারবেন না । একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা শোনা যাক ।

কস্মিনকালেও বিরিয়ানীর ফরমুলা নিয়ে বা রন্ধন পদ্ধতির ধারধারিনি । গ্রাম বাংলায় বাড়ি সেখানে চ্যাং মাছের ঝোল , ট্যাংরার ঝাল, লাউ শোল, বড়ি দিয়ে ছোলার শাক এই সব ছিলো আমাদের প্রিয় খাদ্য । আর্মিতে কাজ করার সুবাদে চিকেন মটন মিলিয়ে মিশিয়ে ভেজ নন-ভেজ খাবার চিনতে শিখি, অবসরের পর আই-টি জয়েন করে শিখি ফাস্ট ফুড আর বার্গার পিজ্জার স্বাদ । বয়সের সাথে সাথে  বেশ বুঝতে পারি । ভাত রুটি আলুর দমের পাশে পাশে দেশে  বিরিয়ানী জিনিসটা আজকাল বেশ চলছে । বোধগোম্য হয়েছে বিরিয়ানী হলো একটু সুস্বাদু হওয়ার একটা প্রক্রিয়া, লাল হলুদ তেলতেলে ভাত যা মাংস আলু ডিম সহকারে কোন খাদ্যদ্রব্য যা যে কোন রেস্তোঁরা সিনাতানকে সার্থক সোয়াদিস্ট বানিয়ে ফেলেন । এমন কি দিনে রিক্সা রাতে পাচক এই পঞ্চাশোর্ধ পাঁচুদাও পাড়ার মোড়ে সত্তর টাকা কেজির পসরা সাজিয়ে বাজার ধরে ফেলেছেন । 

সেবার বইমেলা শেষ । মেলা শেষে করে আমি আর দীপঙ্করদা হোটেল ডি-বেংগলে ফিরছি । দিল্লি থেকে আমরা এক সঙ্গে টিকিট করি, এক হোটেল রুম নিই, এক ট্যাক্সি ভাড়া করে বইমেলা ঘুরতে যাই । আমাদের হোটেলটা মেন রোডে । শিয়ালদহ ফ্লাইওভার থেকে হাঁটা পথ । অফিসযাত্রী , ট্যাক্সি, রিক্সাওয়ালারা ভীড় করে থাকে । অফিস কাচারি ব্যাবসা গুটিয়ে অগনিত মানুষ লোড করে বাসগুলো ছুটে চলেছে মফস্বলের দিকে । দিনের শেষকরে সবাই একটা উপসংহারের দিকে ফিরে যাচ্ছে ।  আমার খিদে পাচ্ছে । দিনের শেষে একটা সলিড খাবার আমার জীবন দর্শন । আমার কবিতায় খাবার আর খোরাকের চিন্তাও বারবার আসে ।  আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ আশেপাশে বিরিয়ানী রান্না করছে । বিরিয়ানী একটা বিশ্বাস আর  আঘ্রান হলো উদ্দিপক । হোটেল ডি-বেংগলে খাবার দেয় না । বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয় । তো আমি দীপঙ্করদাকে কনভিন্স করলাম যে বিরিয়ানী হলো এখন শ্রেষ্ট কাব্য দর্শন । দুপ্লেট প্যাক করে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে । বিরিয়ানীর খোঁজে কিছু রেস্টুরেন্টে আমাদের কথোপকথন তুলে দিচ্ছি ।  প্রথম দোকানঃ X ।

 দোকান-X: "আসুন দাদা "

আমিঃ  "বিরিয়ানী আছে ? "

দোকান-X: "আছে । কি বিরিয়ানী ? চিকেন, মটন, আলু, ডিম, ভেজ...বলুন"

দীপঙ্কর দত্তঃ “না মানে ভালো বিরিয়ানী কি  আছে ? গরম হবে ?”

দোকান-X: “গরম গরম দাদা, আমরা বাসি মাল রাখি না । তাড়াতাড়ি বলুন , পেছনে কাস্টোমার দাঁড়িয়ে আছে ”

আমিঃ “এইগুলো কি বিরিয়ানী হাইদ্রাবাদী নাকি লাখনৌ নাকি কাশ্মীরি ?”

দোকান-X: “কোথা থেকে এসেছেন ?”

আমিঃ “আমরা দিল্লি থেকে এসেছি”

দোকান-X: “কলকাতার স্পেশাল আমাদের বিরিয়ানী খেয়ে দেখেন , সব ভুলে যাবেন”

দীপঙ্কর দত্তঃ “গরম হবে তো”

দোকান-X: “দুমিনিট লাগবে দাদা, গরম করে দেবো”


ফেব্রুয়ারী তখনো ক্যালেন্ডার থেকে মুছে যায়নি । একটু একটু শীত । দুমিনিট ঠান্ডা মাথায় ভেবে বিরিয়ানী গরম করার অর্থ আন্দাজ করতে পেরে আমরা পরের কাস্টোমার কে এগিয়ে দিয়ে পাতলি গলি খুঁজে অন্য একটা রেস্টোরেন্টে এসে পৌঁছালাম ।  সেখানে কথোপকথন এই রকমঃ

দোকান-Y: "বলুন"

আমিঃ  "ভালো বিরিয়ানী আছে ? "

দোকান-Y: "হ্যা, বসুন । "

দীপঙ্কর দত্তঃ “না মানে, এখন খাবো না । প্যাক হবে” ।

দোকান-Y: “কি নেবেন ? চিকেন না মটন” ।

আমিঃ “ভালো কোনটা হবে” ? 

দোকান-Y: “কোথা থেকে এসেছেন” ? 

আমিঃ “আমরা দিল্লি থেকে এসেছি” ।

দোকান-Y: “এই পুরো শেয়ালদায় এই মাল পাবেন না, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান অব্দি চলে যাচ্ছে এই বিরিয়ানী । এক বার খেলে বারবার আসতে হবে” ।

দীপঙ্কর দত্তঃ “গরম হবে তো” ?

দোকান-Y: “দুমিনিট লাগবে দাদা, গরম করে দেবো” ।


এখনো শীত আছে, কিন্তু তেমন কিছু ঠান্ডা না । বিরিয়ানীর অল্টারনেটিভ হিসাবে রাত্রে রুটি সহযোগে চিকেন কসাও তেমন খারাপ জমবে না বলে মন্তব্য করলো দীপঙ্কর দা । আমার মন বিরিয়ানীর দিকে । দিল্লি থেকে এতদূর কলকাতা এসে বিরিয়ানী খাবো না ? কিন্তু গরম খাবার রাখার চল নেই কোথাও বোঝা যাচ্ছে । হাড়িতে গরম করা গরম গরম বিরিয়ানীর কাল্পনিক গন্ধে আমার মন মৌ মৌ করছে আর দীপঙ্কর দা বার বার বলছেন জলদি করো , হোটেলে বন্ধ করে দেবে । পথে একটা ঠেকা থেকে কিছু দারু বা পান যোগ্য ভোদকা কিনতেও টাইম লাগবে  । আমি বললাম, আর একটা দোকানে ট্রাই মারি, দেখি যদি ভাল বিরিয়ানী পাওয়া যায় । আর একটা রেস্টোরেন্টে পৌঁছালাম ।


দোকান-Z: "দাদা আসুন"

আমিঃ  "ভালো বিরিয়ানী চাই "

দোকান-Z: “আমাদের বিরিয়ানীই সেরা ।  সিল প্যাক । ব্রান্ডেড , ক প্লেট ” ?

আমিঃ  “দুপ্লেট হলেই হবে ? প্লেটে কটা পিস থাকে” ? 

দোকান-Z: “কোথা থেকে এসেছেন” ? 

আমিঃ “আমরা দিল্লি থেকে এসেছি” ।

দোকান-Z: “দিল্লির বিরিয়ানী তো খেয়েছেন, কলকাতার বিরিয়ানী খেয়ে দেখেন , স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় । কোন গ্রেভী লাগে না”

দীপঙ্কর দত্তঃ “গরম হবে তো” ?

দোকান-Z: “দুমিনিট লাগবে দাদা, গরম করে দেবো” ।

আমিঃ “ঠিক আছে , গরম করে দিন” ।


আমি আর দীপঙ্কর দা এখন হোটেলে ফিরেছি । এহেন মওকায় দু-চার পেগ না লাগালে দীপঙ্করদার নির্জলা যায় । ঘুম আসে না । ক্রমাগত পান চলছে । এই ব্রেকে পাঠক, ঐ তিনটে কথোপকথনে একটু নজর লাগান ।  আমি যখনই কিছু দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করছি, তখনই ঘাঘু দোকানদার আমাকে চিনে ফেলছে যে আমি এই এলাকার বাসিন্দা নই । কিংবা হয়তো বাজারে নতুন এসেছি । আর দীপঙ্কর দা বারবার খাবার গরম আছে কি না জিজ্ঞাসা করছেন । কারন উনি জানেন দোকানদারগুলো ঘাঘু  নিজের মাল বেঁচে দেবেন । পান পাত্র হাতে দীপঙ্করদা এই সব ঘাঘুদের কবিতার রুপক হিসাবে ভাবছেন আর আমি ভাবছি কবিতা দর্শনের কি হবে । একটা দিনের হিসাবে একটা উপসংহার তো চাই । এই বাজার, খাদ্য, কবি নিয়ে একটা ত্রিভূজ । মাঝে একরাশ খিদে জমে আছে ।  আমি ভাবছি দু-নিবালা খটকে নিলে কেমন হয়, আর হোটেল ডি-বেংগলের রুমে দীপঙ্কর দা দুবোতল ভোদকা আর কাঁচা পেয়ারা মাখা সহযোগে সাবাড় করে আমাকে শেখাচ্ছেন জ্যামিতির গুঢ় রহস্য ।  “বুঝলে হে তরুন কবি, বিরিয়ানীর প্যাকেট ছিঁড়ে একখানা চাইনিজ ক্লের প্লেটে মাল্টা উঁচুকরে ঢালো । কাটা, চামচ,প্যাকেটগুলো টান মেরে ডাস্টবিনে ফ্যালো । পেগটা শেষ করো । মাংস আলতো করে সরিয়ে পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে বিরিয়ানীর ভাতগুলোকে একটু ক্র্যাস করো, তেল থেকে ভাত যতক্ষন না আলাদা হয়ে যায় ” । পেগটা শেষ করেন দীপঙ্কর দা ।  “দলা মাখা ভাত,  এ হলো সিম্পল খাদ্য । যেটা পাকস্থলী বোঝে ।  যে তেল বেরিয়ে গেলো ওটা বাজার । আর এই চকচকে হলুদ হলো নেশা ” ।  এবার একটা ধামাকা হলো কোথাও । রাস্তায় হবে হয়তো । জোরসে আওয়াজ, টায়ার বার্স্ট ও হতে পারে । কলকাতার ট্র্যাফিক নিজের চালে দৌড়ে চলেছে । হাত থেকে বুঝি প্লেট পড়ে গেলো । "আসল ব্যাপারখানা হলো ভাইয়া, এই ভোদকা, এই পেয়ারা চাট, এই লবন জল আর চিনে বাদাম,  ইট গো ইন দা সেম প্লেস । ট্রুথ বড়ই চন্দ্রমুখী হে ভাইয়া । "  আমার কাব্য দর্শনে যে পাচন ক্রিয়া কাজ করছিলো তা একটা ডাহা লাই । বিরিয়ানি থেকে তেল আর তেল থেকে জল আলাদা হলো । ট্রুথ ।  বিরিয়ানির গন্ধে কবি রুটি আর কষা মাংস ম্রিয়মান । প্রোডাক্ট থেকে একটা ট্রেল মিথের দিকে চলে গেলো । একটা এনজাইম পাকস্থলীতে বিশ্রীভাবে বিক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে । বদহজম হবে আজ । 


আদতে, সবই বিক্রি হয়ে যায় । সব পণ্যের কাস্টোমার থাকে । প্রত্যেক দ্রব্যের আলাদা খরিদ্দার আছে । কবি দীপঙ্করকে কলকাতার বইমেলা বিক্রি করতে পারেনি । প্রোডাক্টই আলাদা । কেউ কিনতেও চায় নি  । কিনলে কাঁচের আলমারী অশুদ্ধ হয়ে যায় এই ভয় । সে এক  আশ্চার্য সংকর । যা ডিকোড করা বাস কি বাত নেহি  দোস্ত । হয় দাঁত ভাঙে নয় বদহজম হয় । খাদ্যগুণ আলাদা করতে যে উৎসেচক দরকার, তার সিক্রেশন কোথায় ? জিহবায় লেগে থাকা ঘ্রানে মশগুল খাদকেরা হামলে পড়েন বলে যে প্লেটগুলো সাফ হয়ে যায় , ডাক্তার প্যাভলভ দেখিয়েছেন এর সঙ্গে খাদ্যগুনের কোন সম্পর্ক নেই, বরং ক্ষুধার তারতর্মে কি বিক্রি হবে আর কি বিক্রি হবে না তার টালমাটাল বাজার এই উদ্ভট রকমের খাদ্যকে বিশেষ রহস্যময় করে তোলে ।

দীপঙ্করদার কবিতা আমার মাথার উপর দিয়ে যায় । সে তো আগেও যেতো । কিন্তু কি কারনে জানি না একদিন দিল্লি হাটে কবিতা পড়ে ফেরার পথে এইমস্‌ ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে লাল বইটা ( “দীপঙ্কর দত্তের কবিতা” ) খুলে দেখালেন । ৪০ নম্বর পাতা, কবিতা “দি ভার্টিক্যাল রেজ অব সান” কবিতাটা পড়ালেন । কি জানি হয়তো আমরা বোকা বোকা চেহারার উপরে উনার অনেক আস্থা ছিলো  । বললেন তুমিই মাত্র এই কবিতাটির মর্ম বুঝতে পারবে । ভারি আশ্চার্য তার বিশ্বাস । কাকতালীয় ভাবে একটা এক্সপেরিমেন্টের সম্মুখীন হই আমরা দুজনেই । একজন বিশ্বাসী, আর একজন একজন বিশ্বাস । উনি ট্রুথ । আমি খানিকটা লাই ।  আর মাঝখানে কবিতার বোঝাপড়া একটা মিথ ।

আসলে সবার এক একটা বাঁশী থাকে । সময় অসময়ে হাওয়া ভরে দিতে মন করে । কারো বাজে , কারো বাজে না । যখন রাত পোহায়, বাঁশীটিকে কোথাও না কোথাও ঠিকানা লাগাতে হয় । এত যত্নে গড়ে তোলা ভীমপলাশী কারো না কারো হাতে দিয়ে মন কোথাও চলে যেতে চায়, দীপঙ্করদা কি আমাকেই তার বাঁশী হস্তান্তর করতে চেয়েছিলো ? শেষ কবছরে আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম । কনটপ্লেসের কফি হোমে, দিল্লি হাটের বিজলী গ্রীলস, নেহরু প্লেস দেখা করতাম । প্রায় প্রতিদিন আমাদের ফোনে এক এক ঘন্টা কথা হতো । সারাদিন ফেসবুক চ্যটে ব্যস্ত থাকতাম । ইনফ্যাক্ট আমার অন্য কোন বন্ধুর অভাব অনুভব হতো না ।  দিল্লিতে আমি এত পপুলার ফিগার ছিলাম না । একবার দিল্লির কবি ও সম্পাদক অরুন চক্রবর্তী একদিন তার বাসায় কবিতা পাঠের আয়োজন করেন । দিল্লির বেশ কয়েকজন জাঁদরেল কবিদের ডাকা হয়, আমার সংগে জানা পরিচয় না থাকায় আমাকে ডাকা হয়নি । দীপঙ্কর সেটা জানতে পেরে আমার নাম প্রোপোজ করে । দীপঙ্কর দত্তকে খুব স্নেহ করতেন অরুন চক্রবর্তী । সেই সভায় আমি গেলাম ও আমার সেই ট্রেড মার্ক ‘আর্মি’ মার্কা কবিতা পড়লাম । অস্তনির্জন দত্ত জাহাঙ্গীর সিরিজের কবিতা পড়লো । অগ্নি রায়, ভাস্বতী গোস্বামী, দিলীপ ফৌজদার ও ছিলেন সেই সভায় ।  তো কবিতা পাঠের আসরে একটা বিতর্কের সুত্রপাত হয় । সেই বিতর্ক নিয়ে পরে কোনদিন আলোচনা হবে । এবার এক্সপেরিমেন্টটা করলেন দীপঙ্করদা, আর একটা জিনিস এই পরিষ্কার হয়ে গেলো যে দীপঙ্কর দত্ত আমাকে স্নেহ করেন এটাও একটা সত্য । আমিও কবি বনে গেলাম এটা একটা লাই । এতে কারো ছেঁড়া গেলো এটা একটা মিথ ।

এই ভাবে আমি বার বার বুঝতে চেয়েছি যে দীপঙ্কর দা একজন সত্যিকারের মেন্টর, এক সাহসিক শিল্পী, আত্মপ্রত্যয়ের বিশ্বাসী এককবি, যে কবিতাকে নিয়ে একলা থাকতে চাইতো । প্রথমে সে একা একা ওয়েবসাইট বানাতো ।  http://shunyakaal.yolasite.com এ তখন শূন্যকাল ওয়েবজিন হোস্ট করতো । পেশাগত ভাবে আমি একজন সফটওয়ার প্রোফেশনাল । একদিন এই নিয়ে আমার সংগে দিল্লি হাটে কথা হয় । ল্যাপটপে বাংলা ফন্ট ছোট বড় আসছে বলে আমাকে জানায় । আমি কিছু কিছু সমাধান দিই, কিন্তু পরের দিন আবার সেই সমস্যা । আসলে অভ্রতে টাইপ করাতে বেশী স্বচ্ছন্দ ছিলো না । গুগলে টাইপ করতো । ল্যাপটপ ফরম্যাট করার পর সেই সমস্যা ঠিক হয়ে যায় । শূন্যকাল পত্রিকা একটি মাত্র পেজে সমস্ত কবিদের লেখাগুলো নিয়ে বের হতো । এক সময় আমাকে বলেছিলো যে বাক্‌ পত্রিকার মতো লিঙ্ক বেসড পত্রিকা করতে চায় । তাতে লেখকদের নামে মেনু হবে এবং পাঠকেরা লেখকের নামে ক্লিক করে করে লেখাটি খুলবেন অন্য পেজে  । সেখানেই কামেন্ট দেবেন । সেই ভাবে আমি শূন্যকাল পত্রিকার এডমিন কাজ দেখা শুরু করলাম । মাঝে মাঝে দু একটি লেখা নিয়ে আমাদের মাঝে সাহিত্য ভিত্তিক আলোচনা হতো । আমি হাঁয়ে হাঁ আর নায়ে না মিলিয়ে কথা বলতাম । বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ডিসিশন নিতাম কি বলতে চাইছে । কিন্তু আশ্চার্য ভাবে কিভাবে একদিন শূন্যকালের কাব্যদর্শন আমার মনে দারুন ইম্প্যাক্ট করা শুরু করলো । আমি শূন্যকাল কে আপনা ভাবা চালু করলাম । লেখা নেওয়া, এডিট করা, লে-আউট ডিসাইন, প্রচ্ছদ করা , ভিডিও শুটিং করা । নানান রকম কাজে আটকে গেলাম । সম্পাদনার কাজ আমি সত্যি কোনদিন করিনি । কিন্তু দীপঙ্কর নামক পরশপাথরে মাটিও রাঙিয়ে যায়, এখানে মিথ হয়ে গেলো সত্য , সত্য হয়ে অপার আর মিথ্যারা উদ্ভট । শূন্যকালে পত্রিকার পরিচিতি দুবছরেই ডবল হয়ে গেলো । দীপঙ্করদা কবি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক সফল সম্পাদক হয়ে বাংলা কবিতার পটভূমিকায় নিজের কাব্য প্রতিভার অনন্য নিদর্শন রেখে গেলেন ।

আমি বেশী সময় করে উঠতে পারতাম না, এখনো পারি না । মাল্টিন্যাশনালে কাজ করি । সেবার জামসেদপুর থেকে কবি বারীন ঘোষাল দিল্লিতে এলেন । সি আর পার্কে তার আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন । দীপঙ্করদা আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করে জানালেন যে যদি আমি দেখা করতে যাই, তবে উনি আমার সঙ্গে যাবেন । সেই মত একসঙ্গে সি আর পার্কে গিয়ে দেখা করি । বিকালে চা পান হয়  । সেখানে কথা হয় একদিন বসে কোথাও কবিতা পাঠ করা যায় কিনা, খানিকটা মদ্যপান ও করা যায় । এই ব্যাপারে উৎসাহী কবি দিলীপ ফৌজদার নিজের বাড়ি সরিতাবিহারে একটি কবিতা পার্টির আয়োজন করেন । দিল্লির অনেক কবিরা উপস্থিত ছিলেম, উপযুক্ত পান হয় । কবিতা পাঠ দারুন ভাবে জমে ওঠে । আমি ঝুলি থেকে একটি ব্লেন্ডার্স প্রাইড দীপঙ্করদাকে উপহার দিই । খোলা হয় না । কবি দীপঙ্কর দত্তের সেরা কবিতা “পোতাশ্রয়” কবিতাটি পড়তে আমি অনুরোধ করি । কবিতা পড়া হয় না, বরং একটা বচসা এসে উপস্থিত হয় । সেই নিয়েও কোনদিন হয়তো লিখবো । যেটা এখন লেখার সেটা হলো দীপঙ্কর দত্ত সেদিন না খেয়ে বাড়ি সেই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যান ।

সেই থেকে তিনি একলা থাকতে শুরু করেন । কবিতা আড্ডা বন্ধ । কথাবার্তা বন্ধ । কোন কবিতা  আড্ডায় তিনি আর যান না । আমি মাঝে মাঝেই ফোন করে ওকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকি ও একটা রেগুলারিটির মধ্যে রাখার চেষ্টা করি ।  দিল্লির অন্যান্য কবিদের সাঙ্গেও তার একটা ভার্চুয়াল দূরত্ব তৈরী হয় । তার অভিমান বুঝতে অন্যদের তেমন আগ্রহ ছিলো না । এগিয়ে এসে দীপঙ্করকে সাপোর্ট না দেওয়ার জন্য দীপঙ্কর খুব ব্যথিত ছিলেন । আমার সঙ্গে কথা হতো । আমি জিনিসটার মধ্যস্থতার চেষ্টা করতাম, কিন্তু জুনিয়র হওয়ার কারনে আমাকে সবাই বলতেন, “সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে” । কিন্তু এটা বুঝেছি দীপকংরদা ভয়ংকর ভাবে একা হয়ে গিয়েছিলেন । হয়তো সেই কারনেই আমাকে এতো আপন ভাবতেন, অনেক টেকনিক্যাল খবরাখবর আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন । পত্রিকার পাসওয়ার্ড, ইমেলের পাসওয়ার্ড ও আমাকে উনি দিয়ে রাখতেন । ফোনে কারো মেসেজ এলে আমাকে খুলে দেখাতেন । প্রাইভেট চ্যাট আমাকে শেয়ার করতেন । কোন কোন কবি কোন কোবিনীকে প্রপোজ করেছে, কে চড় খেয়েছে, এই নিয়ে আলোচনা হতো । ডিমোনিটাইজেশন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবিদের সঙ্গে তার মতের পার্থক্য নিয়ে অনেক চ্যাট আছে । নতুন কবিতা, পোস্টমডার্ন কবিতা, পুনরাধুনিক কবিতা, আবহমান কবিতা , ছন্দের কবিতা সমস্ত নিয়ে দিন রাত আমাদের একতা ভার্চুয়াল জগত গড়ে উঠেছিলো ।  ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা ছাড়া যে কোন বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা হতো । শূন্যকয়াল পত্রিকার অনেক দায়ভার নেওয়ার কথা বলতো । মনে মনে সে আমাকে শূন্যকালের পরবর্তী সম্পাদক ভাবতো এবং সেই নিয়ে একদিন আমাকে কারো সাথে চ্যাট করে সেই কথোপকথন আমাকে ফরোয়ার্ড করে । কিন্তু সামনা সামনি কিছু বলতো না । কোথাও আটকে গেলে রাত বারোটার পরেও আমাকে কল দিতো । সম্পাদকীয়তে আমি বেশী সাড়া দিতাম না । আমার বিশেষ পরিচিতি নেই । উনি শূন্যকালের লেখকদের সঙ্গে ওর ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন । আমি শূন্যকালের অ্যাডমিন কাজ নিয়েই খুশী ছিলাম ।  


কিন্তু দীপঙ্করদা কি এতে খুশী ছিলেন ? নিজের কবিতায় , নিজের প্রত্রিকায় ? উত্তর হলো  । না । উনি বলতেন “পত্রিকা বন্ধ করে দেবো । আমার এখন নিজের কবিতাই নিজের ভালো লাগে না । আমি যে প্রত্রিকা করি , তাতে যে কবিতা আমি ছাপি তা ছাপার যোগ্য নয় । আমাদের আজকের কবিতা লিখতে হবে” । তরুন কবিদের কবিতায় হতাশ ছিলেন । বলতেন “প্রচন্ড সত্তর দশকের গন্ধ আসছে । পঁচাগলা গন্ধ । আজকের কবিতা চাই । আজকের প্রতীক, আজকের ভাষা, যে ভাষায় রাস্তা ঘাটে, পানের দোকানে, পরাটাবালা গলিতে কথা বলি । একটা এক্স ফ্যাক্টর আনো । এমন উপমা আনো যা কেউ আগে আনে নি, কবিতা এক রৈখিক হয়ে যাচ্ছে , মাল্টি ডাইমেনশন আনো , ভাষাকে সাজাও , বিষয় বিবেচনায় রিসার্চ আনো , মাইনিউট ডিটেলস দাও” । পাঠক একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে কবিতার এই ক্যারাক্টারিস্টিক গুলি পোস্ট মডার্ন ক্রাইটেরিয়াগুলো কে অতিক্রম করে গেছে । বরং বলা যায় সমসাময়িক কবিরা যখন হাফ ব্যাকে খেলছে । দীপঙ্করদা মাঝমাঠের দখল নিতে বলতেন । আর সময় সুযোগে ফরওয়ার্ডে উঠে এসে গোল ।  কবি তো সবাই হতে চায়, কিন্ত সাধনা কৈ । বাউল তো হতে চায় মন, কিন্তু বাউল হতে তো বস্তা পেতে মাটিতে বসতে হয় । চেয়ার টেবিলে বসা কবিরা মাটিতে বসবেন কেন ? পাছায় তো ধুলো লেগে যাবে । সোসাল মিডিয়ার যুগ । কবিতার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে । কবিরা নিজেই নিজের কপি হচ্ছে  । নিজেদের উল্লাস নিয়ে ব্যস্ত, তাদের কাছে ক্রাইটেরিয়া কোন ক্রাইটেরিয়া নয় ।  আর তখন  দীপঙ্করের এই উদ্ভট মারকাটারি পাওয়ার পোয়েট্রি আর শূন্যকাল সৃষ্টিশীল যুক্তি তর্ক এক সাহিত্যের নির্ভরযোগ্য মুখ হয়ে উঠেছিলো । আমরা কাজ ছিলো সঠিক ট্রেণ্ডটা ধরার । সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলাম এক স্বপ্নের এক উড়ান যাত্রার । আমার নিজের কবিতা নিয়েও প্যাশন বাড়ছিলো দিনে দিনে । আমি নিজেকে নিয়েই এবার একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জায়গায় ছিলাম । সত্যি বলছি,  শূন্যকালকেও এক অনন্য উচ্চাতায় পৌঁছে দেবার কথা ভাবছিলাম ।  ঠিক এমন সময়, বলা যায় অসময়, তার সম্পাদনা, কাব্যপ্রতিভা , ফ্রেন্ড , ফিলোজফার নিজের ফু দিয়ে নিজের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে আমাদের সমস্ত আয়োজন যেন মিথ্যা করে দিয়ে গেলেন । বাইরে হৈ হল্লা । ক্লোন কবিরা “ইহাই একমাত্র সত্য” বলে উল্লাস করে চলেছে আর কবি দীপঙ্কর দত্ত নিজেই মিথ হয়ে গেলেন ।