শিল্পমন, শিল্পের সীমানা









শিল্পমন, শিল্পের সীমানা


ব্যক্তির দেখা অভিজ্ঞতা এবং অর্জিত জ্ঞানের মানদণ্ডে শিল্পের সীমানা নির্ণয় করা যেতে পেরে।  শিল্প মূলত রুচির তারতম্য অনুযায়ী ভিন্নতর ব্যঞ্জনা এবং রূপরসগন্ধে উপস্থাপিত হয়। শিল্প মানুষকে মুগ্ধ করে, ভুলিয়ে দেয়, আচ্ছন্ন করে, ঘোরগ্রস্ত করে। হাওয়ার প্রবাহে যেমন বৃক্ষলতা দোলে, সৃষ্টি হয় জলতরঙ্গ। শিল্প তেমন এক হাওয়ার প্রবাহ। যার স্পর্শে অনুভূতির সুপ্তদুয়ার হয় উন্মোচিত। গুপ্তগুহার অন্ধকারে আলো এসে জাগিয়ে তোলে শৈল্পিক সুন্দর। স্বপ্ন ও বাস্তবের ভাবকল্লোলে প্লাবিত  করে ব্যক্তির অন্তর্লোক।


এতক্ষণে নিশ্চয় আন্দাজ করা যাচ্ছে শিল্পের চৌহদ্দি। কেবল সত্য ও সুন্দরের বার্তা নিয়ে  শিল্পযাত্রা। যার শিল্পমন আছে। তিনি মানুষ হিসেবে অপর ব্যক্তি বা প্রাণির জন্য কল্যাণকামী। তিনি আশাবাদী ও উদার। প্রাণপ্রাচুর্যময়  মনোভঙ্গি নিয়ে সদা পথ চলেন। প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে আবিষ্কার করেন নিজস্ব সুন্দর। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে যে অসীম লীলা ক্রিয়াশীল। শিল্পমনা ব্যক্তি সেটা অনুধাবন করতে কিছুটা হলেও সক্ষম। 


তাহলে কে সেই শিল্পমনা ব্যক্তি? কীভাবে শিল্পমন অর্জন করা যায়? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়ে অন্য অনেকের মতো আমিও ভাবিত হই।  ধারণা করি, মানুষ তার শিল্পসামর্থ অনুযায়ী পৃথিবীকে দেখে, উপভোগ করে। পৃথিবীর অগণিত, অভাবিত বিস্ময় দেখে মানুষ যেমন হাজার বছর ধরে বিমুগ্ধ চিত্তে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, করে চলেছে। এটা সম্ভব হয়েছে শিল্পবোধের গুণে। উচ্ছ্বসিত হবার কিংবা বিমুগ্ধ হবার এই কৌতূহলী মনোভাব আছে বলেই মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখে। বেঁচে থাকার আনন্দ লাভ করে। নতুন কিছু আবিষ্কারের পথে হাঁটে। দৃষ্টিগ্রাহ্য আহারের বাইরেও পৃথিবীতে অজস্র  উপলব্ধিজনিত আহার আছে বলেই আমৃত্যু অতৃপ্তিতে ভোগে। অর্থাৎ যিনি সত্য ও সুন্দরের অন্বেষায় বস্তুজগৎ কিংবা সৃষ্টিজগতকে বিবেচনা করেন। তিনিই ক্রমশ শিল্পবোধ প্রাপ্ত হন। 


উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তাজমহল পৃথিবীর অন্যতম অত্যাশ্চর্য শিল্পনিদর্শন। তাজমহল দেখার জন্য পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। এখন প্রশ্ন হলো, তাজমহলের রূপসৌন্দর্যের দ্যুতি সবাইকে সমানভাবে আন্দোলিত করে কি? সম্ভবত না। সম্ভবত বলেছি কারণ, আমি নিজেই তাজমহল দেখতে গিয়ে পৃথকভাবে কয়েকজনের কাছে একই প্রশ্ন রেখেছি। খেয়াল করে দেখেছি  উত্তরে বিস্তর ফারাক। শিক্ষা, বয়স ও অভিজ্ঞতার আলোকে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখা যায়। 


'তাজমহল কেন দেখতে এলেন? কিংবা 'তাজমহল দেখে কেমন বোধ হচ্ছে?' এই প্রশ্নের জবাবে একজন বললেন, 'ভাষাহীন। অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।' একজন বললেন, 'তাজমহল নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পড়ে বিস্মিত হয়েছি। তাই দুচোখ ভরে দেখার জন্য ছুটে এসেছি।' একজন বললেন, 'তাজমহল দেখে মন চাইছে বাড়ি ফিরে না যাই। তাজমহল চত্ত্বরের সবুজ ঘাসে শুয়ে কেবল অবগাহন করি অপার সৌন্দর্য।'' একজন বললেন, 'খারাপ না। ভালো লেগেছে। তবে এরচেয়ে সুন্দর বিল্ডিং আমার এলাকায়ও আছে। সবাই দেখতে আসে। তাই আমিও এসেছি।' 


বয়সে তরুণ এমন একজন উত্তর দিলেন, 'বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছি। প্রেমের নিদর্শন তাজমহল। না দেখলে হয়? ছবি তুলবো। এইতো।' 

একটি শিশুকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়- 'বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছি। খুব একটা ভালো লাগেনি। তারচেয়ে কোনো শিশুপার্ক কিংবা চিড়িয়াখানা আরো সুন্দর।'


সুন্দর দেখে বিমুগ্ধ হওয়ার মধ্যে এই যে বিস্তর ফারাক। এটা হয়েছে ব্যক্তিভেদে উপলব্ধিগত শিল্পবোধের তারতম্যের কারণে। যাকে তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় 'শিল্পের সামর্থ' কিংবা 'শিল্পের সীমানা'। ব্যক্তির বয়স, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে শিল্পমন কিংবা শিল্পরুচি তৈরি হয়। সেই অনুযায়ী শিল্পস্বাদ আস্বাদন সম্ভব হয়। খেয়াল করে দেখুন, একই নাটক দেখে একজন কাঁদছে, অপরজন নির্বিকার। একই কবিতা পড়ে একজন লিখছেন 'অসাধারণ'। অপরজন ভাবলেশহীন। একই গান শুনে একজন বিমোহিত হয়ে ভাবসায়রে হাবুডুবু খাচ্ছেন। অপরজনের কাছে এটা শ্রেফ আদিখ্যেতা। বস্তুত শিল্পের সীমানা কিংবা রসসঞ্চারের তারতম্য এভাবেই তৈরি হয়।


সৌন্দর্যতাত্ত্বিক চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোধকরি এটাকেই বলেছেন সুন্দরের তারতম্য। সুন্দর অসুন্দর বলে কিছু নেই। এটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আরোপিত একটি ব্যাপার। তাঁর ভাষায়- 

'প্রকৃতপক্ষে যে নিজস্ব রূপ তা সুন্দর নয়, কুৎসিতও নয় … সত্যি বলতে আমাদের মন ছাড়া আর কোথাও সুন্দর বলেও কিছু নেই, কুৎসিত বলেও কিছু নেই।' (বাগেশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধাবলী)


তিনি বলতে চাইছেন 'মন ছাড়া আর কোথাও সুন্দর বলেও কিছু নেই, কুৎসিত বলেও কিছু নেই।' তবে তাঁর কথার রেশ ধরে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শিল্পবোধ কিংবা শিল্পের উপলব্ধিগত তারতম্য একান্তই মন নির্ভর। যার মন যেমন ধাতু দিয়ে গড়া। তিনি সেই বিবেচনায় শিল্পের সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন। আজন্ম গ্রামের জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ যেমন নিসর্গকেন্দ্রিক মনন নিয়ে বেড়ে ওঠেন। পক্ষান্তরে  আজন্ম শহরে বাস করা ব্যক্তির মনন তৈরি হয় নগরকেন্দ্রিক আবহ ধারণ করে। কারো কারো মানসগঠনে আবার এদু'টির উপস্থিতি থাকে। রবীন্দ্রনাথ শিল্পসুন্দরের এই বোধকে জারিত করেছেন কাব্যভাষায়-


'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

আমি চোখ মেললুম আকাশে,

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর',

সুন্দর হল সে।

তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,

এ কবির বাণী নয়।

আমি বলব, এ সত্য,

তাই এ কাব্য।

এ আমার অহংকার,

অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।

মানুষের অহংকার-পটেই

বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।'       (আমি/ শ্যামলী) 


চেতনা কিংবা মনের সীমানায় শিল্পের অধিবাস। দর্শনসত্যে এটাই বারবার ধ্বনিত হয়েছে। যিনি শিল্পী কিংবা যিনি শিল্পরস আস্বাদনে আগ্রহী, উভয়ের জন্যই শিল্পমন জরুরি। আমাদের চেতনার রঙে যেভাবে পান্না হয়ে যায় সবুজ। আবার চুনি হয়ে ওঠে রাঙা, গোলাপের দিকে তাকিয়ে সুন্দর বলায় জনসাধারণ্যে গোলাপ এখন সুন্দরের অভিধা পেয়েছে। 


সর্বোপরি, শিল্পমন কিংবা শিল্পের সীমানা ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির যোগফল। যিনি দর্শনে এবং অনুভবে যতবেশি সত্য, সুন্দর ও আনন্দের অনুগামী। তাঁর শিল্পমন কিংবা শিল্পের সীমানা ততো প্রসারিত।