ভয় 

নন্দিতা সাহা 




তপন  সান্যালের অভিজ্ঞ দুই চোখ  সজাগ হয়ে উঠল  |  আটপৌরে অল্প বয়সী মহিলার চারপাশে যেন একটু রহস্যের গন্ধ পেলেন |  বেশ কয়েক বছর পরে তপনবাবু এসেছেন  ঝুমা দের বাড়ি  | ছোটবেলা থেকেই ঝুমাকে দেখে আসছে,  কোলে কোলে নিয়ে ঘুরেছে , আবার বিয়ের সময় এসে তপনবাবুই   কন্যা সম্প্রদান করেছিলেন | ঝুমার বিয়ের পর অবশ্য তেমন একটা দেখা হয়নি , আজ বহু বছর পর লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পথে ঝুমা দের দিল্লির বাড়িতে একদিন হল্ট  করলেন  | 

              ঝুমাও এখানে এই সুদূর দিল্লিতে সংসার নিয়ে ব্যস্ত  | একটিমাত্র মেয়ে সবে বারো ক্লাসে পড়ে |   স্বামী কন্যা নিয়ে ভালোই আছে | আরামের জীবন |    তবে এই কিছু মাস আগে ওদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল  |পুরনো কাজের মেয়ে ঊষা বাই হঠাৎ কাজ ছেড়ে চলে গেল  | আর কি  !   ঝুমার  তখন কাজ করতে করতে জিভ বেরিয়ে যাবার মত অবস্থা !    হন্যে  হয়ে কাজের লোক  খুঁজছিল |    তবে এবারে ঝুমা ঠিক করেই রেখেছিল কোন বাঙালি কাজের মেয়ে রাখবে  |   

                  দিল্লি , নয়ডা ,  গাজিয়াবাদের আনাচে-কানাচে বহু বাঙালি আছে যারা রিকশা চালায় , লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে , মিস্ত্রির  কাজ করে ,ইত্যাদি ইত্যাদি  |  তাছাড়া  ঊষা বাইয়ের হাতে মোটা মোটা  আলুর পরোটা , রাজমা , ছোলে , টমেটো র  টক আলুর দম খেতে খেতে হাঁফ ধরে গেছে  | বাঙালি কাউকে পেলে বেশ বাটি চচ্চড়ি , লাউ চিংড়ি , সরষে  পাতুরি ,  ডালের বড়ি দিয়ে শুক্তানি   খাওয়া যাবে  |  তাছাড়া বাংলায় একটু কথাও  বলা যাবে  , নইলে চারিদিকে কেবল হিন্দি আর ইংরেজি  |  কথা বলতে বলতে হয়রান হয়ে যায় ঝুমা |  

                

    

যাই হোক , সেদিন উল্টোদিকে দোকানের ছেলেটার  সাথে এলো সে  | ঝুমা আপাদমস্তক একবার দেখে নিল |  সিঁথিতে সিঁদুর , হাতে শাঁখা পলা , ছাপা শাড়ি , |  ওর সাথে 6\ 7 বছরের একটি মেয়ে  | দেখেই  পছন্দ |  হাতছাড়া করেনি  ঝুমা |  ঠিক হল সকাল ছ টায় আসবে ,একেবারে সন্ধ্যেবেলায় যাবে  |   ঝুমা খুব খুশি,  বেশ কাটবে দিনগুলো  | মাতৃভাষায় গল্প করে একটু  শ্বাস  নেবে আর কি , তায় আবার উত্তর বাংলার  | 


               কিন্তু ঝুমা যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা হলো না |  কাজের মেয়ে পার্বতী   মোটে কথা কয়না  ! কেবল  হ্যাঁ \ না এর মধ্যেই উত্তর থাকে  | তবে  বাচ্চা মেয়েটা মাঝে মাঝে ফুটফাট বাংলা বলে  |   ওর বাংলা ভাষা শুনে দিয়া খুব মজা পায় , বলে,   মা ওর কথাগুলো ঠিক আমাদের মত নয়  | ঝুমা বোঝায়,  ওরা এসেছে উত্তরবাংলা থেকে |   উত্তর বাংলায় একরকম দক্ষিণ বাংলায় আরেকরকম ভাষার টান থাকে যদিও ভাষাটা বাংলা |    পার্বতীর মেয়ে কাজলি কে ডেকে   দিয়া  মাঝেমাঝেই  ওর  কথা শুনে  | ভালো লাগে  শুনতে  | পার্বতী অবশ্য হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডেকে নেয়, বেশি বলতে দেয় না   | ঝুমা বলে, 

---------------  বাচ্চা মেয়ে কথা বলছে , তুই ওকে কথা বলতে দিস না কেন? 

--------------  না বৌদি , ও ছোট  , কিছু বোঝেনা  , কখন কি বলে |  হয়ত তোমাদেরই তখন খারাপ লাগবে  |


 সে অবশ্য ঠিক কথা  |   কাজলি বই নিয়ে আসে,  সারাদিন খাতা-কলম নিয়ে কি যে করে  ! আবার বিড়বিড় করে ছড়া আওড়ায়  | সবমিলিয়ে ঝুমার বেশ ভালই কাটে  |  বাড়িটা ফাঁকা , খালি খালি লাগে না  | দিয়া তো সারাদিনের নামে সেই কলেজ |     


সেদিন  ঝুমা  ঘর বার শুরু করলো  | কি মুশকিল!  হল টা কি  ! পার্বতীর পাত্তা নেই  | এত বছর পরে সান্যাল মামা এসেছে , একটি দিনই থাকবে  | একটু ভালো রান্নাবান্না  না করলে কি হয় !  এ  দিকে পার্বতীর আজকের দিনটিতেই দেখা নেই |  সান্যাল মামা বর্তমানে গ্লোব টটার  |  সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় , কত দেশের আদব-কায়দা ভাষা বোঝে  | নিজের দেশের কত ভাষা জানে  , রাজস্থানী,  গুজরাটি , মারাঠি , অহমিয়া , স্প্যানিশ | 

            যাইহোক । ভাবতে ভাবতে অবশেষে পার্বতী এল , রান্নাবান্না হল , দুপুরে একসাথে খেতে বসে গল্প শুরু হল  |  দিয়া আজ কলেজে যায়নি,  সান্যাল দাদুর সাথে ওর বেশ জমে  | সান্যাল দাদুও প্রাণ খুলে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে  | বাড়িতে আজ হই হই কান্ড , অনেকদিন পর বাড়িটা একেবারে  সরব ,  মুখরিত | 

         পার্বতী   নিঃশব্দে টেবিলে খাবার   আগুপাছু  করছে  |   হঠাৎ এমন উচ্ছল হয়ে উঠল   !  দুই চোখ চকচক করে বলল , " আপনি চি---------"| 

       আর নয় |  কথাটা গিলে ফেলে রান্নাঘরে  সবার চোখের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো  |  ছোট্ট কাজলিও   স্যাট করে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো |   ঝুমা বলল ,

-------------- কিরে কি বলতে চাইলি বললিনা তো ?  বল , কিছু হবেনা | বল কী বলতে চেয়েছিস | সান্যাল মামা খুব ভালো , বল |

 অগত্যা পার্বতী এসে মুখে একটা হাসি নিয়ে বললো ,

------------- চিংড়ি টা কেমন হয়েছে মামা  ? 

তপনবাবুর হাত  থমকে  গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য  |    বলল , বেশ হয়েছে | 

 

 তারপর  কিন্তু  কেমন পরিবেশ টা  থমথমে হয়ে গেল |  তপন বাবুর চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়  ! তপনবাবু বুঝল পার্বতী আসলে সত্যি কথা বলল না  , ও সত্যিটা  চেপে  গেল | ও অন্য  কিছু বলতে চেয়েছিল  | পার্বতীর চারপাশে এক রহস্যের গন্ধ পেল তপন সান্যাল  | 


বিকেলের সিগারেটটা ধরিয়ে বসে আছে বারান্দায় , কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া এসে পড়েছে , বসন্তকাল,  চারিদিকে সবুজ  | ঝুমা  চায়ের কাপটা রাখল টেবিলের ওপর,  চমকে উঠল সান্যাল  মামা |    ঝুমা  বলল, 

-------------  এক মনে কি এত ভাবছ মামা  ! তোমার মাথায় এখন লন্ডন ? নাকি শংঘাই ? নাকি আরামবাগ ? 


মামার মুখে হালকা হাসি,  বলল,

------------- -একটা কথা বলতে চাই তোকে  ঝুম | কিন্তু ----! 

---------------- কি ?  বল  | আবার কিন্তু কেন  | 

------------- বলাটা ঠিক হবে কিনা সেটাই ভাবছি  |  আচ্ছা এই মহিলাটি কতদিন আছে তোর এখানে ? 

------------- এইতো মাস দুয়েক |   কেন বলতো  ? 

-------------- কোথা থেকে এসেছে  ? 

-------------- বলল তো ওর সবাই উত্তর বাংলায়  থাকে  | আলিপুরদুয়ার থেকেই এখানে এসেছে  | 

-------------- ব্যাপারটা কিন্তু একটু   গোলমেলে |   জানিস ও কিন্তু একটা জায়গার ভাষা ধরতে পেরেছে  | সেটাই বলতে গিয়ে থেমে গেছে |  আমি যখনই চিটাগাংগের বাংলা বলছিলাম  দিয়া কে শোনাবার  জন্য , ও কিন্তু চমকে উঠেছিল  | মেয়েটা খুব চালাক কেমন ঘুরিয়ে বললো চিংড়ি  মাছটার কথা | আমি  শুনেছি, কাজলি  বলছিল , " আমগো  দ্যাশের   মত কথা মা , তাই না !" 

                           তোরা কেউ লক্ষ করিস নি  | তবে সাবধান  |  এখানে কিন্তু আনাচে-কানাচে বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে আছে  | এই মেয়েটা নির্ঘাত  বাংলাদেশি |  আমি ওর চোখে  অস্বস্তি , ভয় এর ছায়া দেখেছি |  কোনো ক্ষতি না করে যায় তোদের , ভিনদেশি বলে কথা  |  


পরদিন   ঝুমা  বসে বসে ভাবছে   মামার কথাগুলো  | আচ্ছা সেই কারণেই কি ওরা  মা  মেয়ে মোটে কথা বলেনা  !  কাজলি বলে,  মা বলে বোবার শত্রু নাই  , বেশি কথা কবি না | 

বড্ড বিরক্ত লাগছে  ঝুমার , খুব রাগ হচ্ছে | মিথ্যুক  |   পার্বতী মিথ্যে বলল !  ঝুমা  পার্বতী কে ডাকল,  পার্বতী এসে দাঁড়াতেই ঝুমার প্রশ্ন,---

-------------------  মিথ্যে বললি  কেন  ? তুই কোন দেশের ?  

পার্বতী চমকে উঠলো  ! এইবার আর নয়  , পার্বতী একেবারে হই হই করে উঠলো  | ওর গলার স্বরে চোখে-মুখে আতঙ্ক উপচে পড়ছে  | পার্বতী কেঁদেই ফেলল ,বলল,

------------------  আমার কোন দোষ নাই গো দিদি  | আমরা বাংলাদেশ থিকা  আইছি | কি করুম ? আমাগো পেটের চিন্তা  , পেট চালানোর জন্য দুই পয়সা রোজগারের আশায় আইছি  | আরো অনেকে আছে , কিন্তু ভয়ে আমরা লুকায় লুকায় থাকি |   কথা কইনা |   কথা কইলে  লোকে ধইরা ফেলে  |  পুলিশে দেয় |   পুলিশে দিওনা দিদি |

                                      কাজলি কে জড়িয়ে ধরে  কান্না শুরু করল  পার্বতী, 

----------------------  দিদি এই মেয়েটার কি হইব !  ওরে  বাবা রে , আমারে যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায় | 

------------------  কিন্তু এখানে এসেছিস কেন ?  তোরা হিন্দু না মুসলমান  ?

------------------ ওইসব চিন্তা মাথায় নাই গো দিদি  | ওই গুলান বড় বড় মানুষ গো চিন্তা , ন্যাতা গো চিন্তা | আমাদের কেবল পেটের  চিন্তা  | যেন নিজের মানুষগুলানরে   ভাত বাইরা দিবার পারি | দুই মাসের ছেলেটাতো  মরল | অভাবে আমার বুকের দুধ শুকয়ে গেল,  ছেলেটাও গলা শুকায়  মরল |  আমরা বাঁচতে চাই  , শুধু খাইয়া পইড়া বাঁচতে চাই  |  |ওরা আমাদের ধরলে আমরা তিনজনে  তিনদিকে ছিটকাইয়া পরমু   দিদি |  

                                      এমনভাবে তো ঝুমা ভাবেনি  | সত্যি  , কি করবে এই অসহায় মানুষগুলো ?  কতদিন ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে |

                               কত দেশ থেকে তো বাস্তুহারা মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে  | এদের কেউ ভালবাসেনা , চায় না  |  এরা কেবল একটি  জায়গায় থাকতে চায় |   প্রতিটি দেশে কত খালি জায়গা , হাইওয়ে ধরে গেলে দেখা যায় মাইলের পর মাইল ধুধু প্রান্তর |   এত বড় বড় দেশ , কত মাটি  !  পৃথিবীতে কত মাটি  ! এরাও একটুকরো মাটি চায়,   যে মাটিতে বসে সন্তানকে আদর করবে , গাছের ছায়ায় একটু ঠাণ্ডা হবে,   গাইবে তারপর  তো প্রকৃতির  নিয়মে  একদিন সবশেষে এই মাটির সাথেই  মিশে যাবে,  মাটি হয়ে যাবে  | অথচ এক  খণ্ড  মাটি  এদের কোন দেশ দিতে চায় না  | এরা উদভ্রান্ত , উদ্বৃত্ত , উদ্বাস্তু , ব্রাত্য   | | অনিশ্চয়তা  এদের  নিত্য সঙ্গী,  এরা ভয়ে ভয়ে দিন কাটায় ,খায় , বাঁচে  | 


              বাইরে বেশ  হওয়া উঠেছে  |  ঝুমার পায়ের কাছ থেকে প্লাস্টিকের খালি ব্যাগটা উড়ে গিয়ে পড়ল গেটের কাছে তারপর দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল পাশের বাড়ির বারান্দায় তারপর নোংরা নর্দমায় |    আর উড়ল না | 

              একটা দীর্ঘশ্বাস |   ঝুমা আড়চোখে পার্বতী আর কাজলের দিকে তাকালো,  সত্যি ওরাও ওই প্লাস্টিকের ব্যাগ  টার মতোই ভাসতে-ভাসতে একদিন পচা নর্দমার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে , ঢুকে যাবে কাল ব্ল্যাকহোলে,  কেউ খুজে পাবে না  |  জানতেও পারবেনা ওরা বাঁচল কি মরল !   কিভাবে বাঁচল , কিভাবে মরল  ! 


           কিন্তু ঝুমা তেমনটা হতে দেবে না,  হতে দিতে পারেনা  | ঝুমা অস্ফুট স্বরে বলল , চিন্তা করিস কেন,  আমি তো আছি  | বলল বটে তবে চিন্তা হচ্ছে বৈকি  |   ঝুমার সাহস আছে প্রতিবাদ করার , কিন্তু   একা কি করে লড়বে  ! আরো সাথী চাই যে | 

   ঘরের ভেতর থেকে চাবি নিয়ে এলো  ঝুমা |   পার্বতীর হাতে দিয়ে বললো ," বাড়ির পেছনের ঘরের চাবি  | এটা দিয়ে ঘর টা খুলে নে , ওখানেই থাক   "  |    এবার পার্বতী আমতা আমতা করে বলল , "   কিন্তু দিদি যদি ওরা --- !        ঝুমা    দৃঢ়  স্বরে বলল , "   ভয় পাস না  |  আমি তো আছি "|