কীভাবে ভোর হয়








আমি জানি না, ভোর হলেই
একটা পাখি ডাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমাতে ঘুমাতে হাঁটি, হাঁটি। ক্রমশ ডাল
পালা পাতার ফাঁক গলে নামতে নামতে শিকড়। মাটির অনেকটা নীচে ঢেকে রেখেছি আমার
ছেলেবেলা



ছেলেবেলা থেকে কেউ সুর করে ডাকে, আয়
আয়...চাঁদমামা টিক্ দিয়ে যা… আমি কখনও চাঁদের দেশে যাইনি, খুব যেতে ইচ্ছে
করে বুড়ির দেশে, পাকা চুল, চরকা কাটছে তো কাটছেই…আমি চরকার সুতো হয়ে আছি,
ঘুরতে ঘুরতে সুতো ধরে নেমে আসছি নীচে, অনেক নীচে। একটা নীল জল, নীল পাহাড়,
নীল সবকিছু…



যমুনা ঠেলে ঠেলে উঠে আসছি, কদম গাছ, তার নীচে
অপেক্ষা করে আছে কেউ। আমাকে যেতেই হবে, আমি হাঁটছি। মেঘ করে এল, ঘন মেঘ,
বিজরী চমক, ব‍্যাঙ ডাকছে, কাদা কাদা কাদা, আমি হাঁটছি...মাটি নেই কেন?
পায়ের নীচ থেকে সরে যাচ্ছ কেন পৃথিবী?



সেই গ্লোবটা, রাখা
আছে পড়ার টেবিলে। ঘুরছে, ঘুরছে আমি পড়ে যাচ্ছি। উঠে দাঁড়াতে পারছি না,
পারছি না। চরকার বুড়ির আঙুলে রক্ত লেগে আছে। ভিজে যাচ্ছি। চ‍্যাটচ‍্যাট
করছে গা, গন্ধ। বমি, বমি। পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, প্রথম ভাত



পেটে
হাত দিয়ে দেখি, নাড়িভুঁড়িগুলো নেই। কে খেয়ে নিল? আঙুলগুলো’ও আর আঙুল নেই,
চামড়া নেই কেন? শুধু হাড়। মাংস কোথায় গেল? সেই হাড়গিলেগুলো আবার এসেছে।
প্রতি রাতে আসে ওরা। সকাল হতেই দূরে দূরে, মেঘ



আমাকে খেয়ে
নেবে ওরা। কখন সকাল হবে? আমাকে ঘুমাতে দেবে না ওরা। কখন সকাল হব? ওরা
চাঁদের মতো একা ফেলে চলে যাবে আমাকে। দগদগে ঘায়ের মতো, চাঁদ জেগে থাকে



আমার
খুব ঘুম পাচ্ছে, আমাকে ঘুমাতে দাও। ছেলেবেলা থেকে কেউ গাইছে, ছেলে ঘুমাল
পাড়া জুড়াল বর্গী এল দেশে...খুব ভয় করছে… আমাকে ঘুমাতে দাও… ওরা আমাকে
মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে, আমাকে ঘুমাতে দাও। ওরা আমার মায়ের সামনেই
আমার মাথাটা কেটে নিয়ে ফুটবল খেলবে...আমাকে ঘুমাতে দাও। আমাকে জাগিও না আর,
আমি চোখে খুললেই দেখতে পাব, মা’কে উলঙ্গ করে টাঙিয়ে রেখেছে ওরা, কেটে নিয়ে
গেছে স্তন, যোনিতে পাথর ঢুকে আছে, ফালাফালা



আমাকে জাগিও
না, ঘুমাতে দাও। সব খাজনা মিটিয়ে দেব। বুলবুলির পেট চিরে নিয়ে আসব ধান।
আমাকে ঘুমাতে দাও। ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে আমাদের ঘর।
আমাকে ঘুমাতে দাও। বাবা কোথায়, মা কোথায়, ভাই, বোন? তোমরা এতো চিৎকার করছ
কেন? আমাকে ঘুমাতে দাও



ওই দ্যাখো, চলে গেছে ওরা, দূরে। ওই
দ্যাখো ধুলো উড়ছে ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠ পেড়িয়ে। ওরা আর আসবে না। ওরা আর আমাকে
ঘোড়ার খুঁড়ে বেঁধে রাখবে না। আমি চলে যাব, আরও দূরে...অনেক অনেক দূরে। সব
ঘুম ঠেলে, ঠিক পৌঁছে যাব...



সেই চাঁদের পাহাড়, মাথায় যাহার, রামধনু রাঙা হয় দেখতে পাব





   






এসো যা কিছু, পারাপার




আমরা একটা ভুল জীবনে বাস করি। ঘটনাবহুল, এমনকি শীতকাল। আমার মুখে কোনও সহজ খুঁজো না, মানসী



সেজেছ,
যা কিছু তুমি মুখ। আমি তাকে সত্যি ভেবে জ্বালিয়ে এসেছি আলো। অভিনয়, কোন
গোপন প্রেমিক নয়। দুচোখে কাজল লেপলে, আমি ক্রমে মাংসাশী হয়ে উঠি



ওসব ঠিক কুয়াশা বলে কিছু নেই। আমরা সবাই, যে যার আয়না। মুখ দেখি, মুখোশ পরি। ভেতরে ভেতরে, আলতো হেঁটে গেলে, ঘর অপেক্ষা রোদ



এসো
দুচোখে গান বুলিয়ে দিই। চোখবুজে, তুমি শোক। এসো যা কিছু, আমাদের গানের
ভেতর, পারাপার, ছিন্নমূল ঠোঁট। নির্ভার হয়ে গেলে, ডোম-ডোমনির দিগন্ত হয়ে
উঠি












সেই মোঙ্গলিকে




মনে পড়ে? জাঙ্গল বুক? আমার ছেলেবেলার
বন্ধু। এখনও। তখন তো সিনেমা ছিল না, কার্টুন চ্যানেল’ও। তাছাড়া টিভি দেখলে
যেহেতু ছোটদের চোখ পচে যায়, সরস্বতী রাগ করেন। তাই, পড়তেই পড়তেই ছবি
দেখতাম। ছবিগুলো জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে সিনেমা, চোখের মনে



ঘুমের
ভেতর ভেতর ঘুম থেকে জেগে উঠেই নামাল ধরে ঝুলতাম। এ গাছ থেকে সে গাছ থেকে
গাছ গাছ...হঠাৎ আর নামাল নেই। ভাসতে ভাসতে পাখি হব না ফল, জানার আগেই ঘুম
ভেঙে যেত



অনেক চেষ্টা করেও পাখি হতে পারিনি কখনও বা ফল।
কিন্তু এই ফলাফলটাকে অমীমাংসিত রাখার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না। ঘুমের ভেতর
তো আমার কোনও পা নেই, হাত'ও। তাই একদিন চড়ে বসলাম আমড়া গাছের ডালে



গাছটা
বেশ বড়ো। ওই দুইতলা কি তিন, বিরাট উঠোনে। নীচে এক ছোট্ট পেয়ারা, আমার
অবসরের পেয়ারাসন পেতে রাখত। পেয়ারা গাছ বেয়ে সোজা আমড়ায়। মগডালে। হাতের
কাছে জুতসই একটা ডাল পেয়ে ঝুলছি তো ঝুলছি। হঠাৎ…



কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারালেও সুখবর এটাই যে, আমি বেঁচে আছি






এক আশ্চর্য আড়ম্বর




এ এক আশ্চর্য আড়ম্বর। আমি অর্থ খুঁজছি, তোমাতে। তুমি হেঁটে যাচ্ছ, পাশাপাশি। তবু তোমার মুখোমুখি হতে পারিনি কখনও



এটাকে
তুমি জেগে থাকা ভেবে ভুল করো না। তুমি এসেছিলে যেদিন, হাত রেখেছিলে। ঘুম
ভাঙিয়েছিলে। আমি সেদিনই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, নিশ্চিন্ত ঘুমে, কাল আর কোনও কাজ
নেই জেনে



বেশ বুঝতে পারছি, শরীরের ভিতরে ঢুকে পড়ছে শরীর।
শরীর থেকেও বেরিয়ে আসছে শরীর। মাঝখানে কোনও দরজা তোলা নেই। আমরা দুজনেই
দুজনের মুখোমুখি, নিশ্চিত দর্শক



এসো হাসি খেয়ে ফেলি, যা কিছু কান্না ভেবেছি আমরা। যা কিছু মেঘের দেশে পুতুল খেলা



তুমি একটুকু এসে বসো, কাছে। ঠিক এইখানে। খুব কাছে নয়। খুব দূরেও নয়। মাঝে একটু ফাঁক রাখো। মিশে গেলে যে, আমি তোমাকে দেখতে পাব না



বাতাস
বলতে আমি, হেঁটে যাওয়াই বুঝি। জল বলতে, আয়না। তুমি দুটোই হও। আর মেঘ ভালো
লাগে না। ঝরো ঝরো। ঝরে পড়ো সবটুকু। বৃত্তের বাইরে জমিয়ে নাও এক মেঘ সমুদ্র।
বৃত্তের পরিধি ধরে আমি একা



এইভাবেই হেঁটে যাব আমরা।
এইভাবেই মেঘ বানাব, বৃষ্টি ছোঁব। সমুদ্রের নীচে যা কিছু আছে, ডুবে যাওয়া
জাহাজ। আমরা ওদের তুলে নিয়ে এসে, হাতের দূরত্বে চালান করে দেব



নাও,
পরিমাপ করে নাও। এই নাও, আমার মুক্তি। এই নাও, তোমার যা কিছু জমানো কথা।
সব দিয়ে, আজ আমি নিঃস্ব হব। তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি। মুঠো খুলে রাখো,
আমি আসছি, জমানো যা কিছু, আমাদের আশ্চর্য আড়ম্বর