‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’…

শিবানী শর্মা



ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে প্রত্যক্ষভাবে গীতা শুনেছিলেন ও তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন অর্জুন ছাড়া আরও তিনজন। প্রথম ছিলেন সঞ্জয়। তিনি দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সমস্ত ঘটনা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য, অর্জুনের রথের চূড়ায় ছিলেন শ্রী হনুমান, তিনি হলেন দ্বিতীয় আর তৃতীয়  ছিলেন ভীমের পৌত্র, ঘটোৎকচ ও অহিল্বতি বা মৌরবির পুত্র বর্বরিক। স্কন্দ পুরাণে বর্বরিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে মস্তক উৎসর্গ করে তিনি মোক্ষ প্রাপ্ত করেছিলেন। 


বীরশ্রেষ্ঠ, দুর্জয় ধনুর্ধর বর্বরিকের গল্পে পরে আসছি, তার আগে বলি একটি তীর্থস্থানের কথা যার নাম ‘চুল্কানা ধাম’। এই পুণ্যস্থান চুল্কানা ধামের নাম আমি খুব সম্প্রতি শুনলাম ও সেই ধাম দর্শন করবার সৌভাগ্যও আমার হলো। হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ জেলার সমলখা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে চুল্কানা গ্রাম, যেখানে অবস্থিত এই চুল্কানা ধাম।


 দিল্লি থেকে চুল্কানা ধামের দূরত্ব আনুমানিক ৬৭-৬৮ কিলোমিটার, সড়কপথে প্রায় দুঘণ্টা সময় লাগে। অজস্র মানুষের বিশ্বাস ‘চুল্কানা ধাম’ সেই পবিত্র ধর্মস্থল যেখানে বর্বরিক শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেয়েছিলেন ও নিজের মস্তক উৎসর্গ করেছিলেন। এই ধাম ‘শ্যামবাবা’র ধাম নামেও প্রসিদ্ধ।  রাজস্থানে এই শ্যামবাবা পূজিত হন ‘খাটুশ্যামজী’ নামে। 





একটি পৌরাণিক কাহিনী জড়িয়ে আছে এই চুল্কানা ধামের সঙ্গে। কথিত আছে দেবী দুর্গার কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন বর্বরিক। সেই তপস্যায় বর পেয়েছিলেন তিনটি বাণ। অদ্ভুত, অমোঘ সেই তিনটি বাণ পেয়ে তিনি হয়ে উঠলেন অজেয়। বর্বরিক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে পক্ষ দুর্বল তিনি তাদের হয়েই যুদ্ধ করবেন। শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞাত ছিলেন বর্বরিক পাণ্ডবদের পক্ষ থেকেই রণক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল মোট আঠারো অক্ষৌহিণী সেনা। 

এগারো অক্ষৌহিণী ছিল কৌরবদের পক্ষে এবং সাত অক্ষৌহিণী ছিল পাণ্ডবদের পক্ষে। তার প্রথম বাণ সমগ্র কৌরব সেনার নাশ করলেও ভীষ্ম, কৃপাচার্য ও অশ্বত্থামা সুরক্ষিত থাকবেন ফলে কৌরব পক্ষ তখন দুর্বল হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে বর্বরিক তাঁর প্রতিজ্ঞার কারণে দ্বিতীয় বাণ দ্বারা পাণ্ডব পক্ষকে বিনাশ করতে বাধ্য হবে।  যুদ্ধের ফলাফল তিনি জানতেন তাই আশঙ্কিত ছিলেন বর্বরিকের এই অংশগ্রহণ পাণ্ডবদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।



এক ব্রাহ্মণের বেশে শ্রীকৃষ্ণ পরীক্ষা নিতে এসেছিলেন। একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, বর্বরিককে সেই গাছের সমস্ত পাতাকে একটি মাত্র তিরে গেঁথে দেখাতে বলেছিলেন। তাঁর অলক্ষ্যে শ্রীকৃষ্ণ গাছের একটি পাতা ছিঁড়ে নিজের পায়ের তলায় লুকিয়ে ফেলেন। বর্বরিকের তির এক মুহূর্তে গাছের সব কটি পাতাকে ছেদন করে যেখানে লুকোনো পাতাটি ছিল শ্রীকৃষ্ণের পায়ের ঠিক উপরে থেমে যায় । শ্রীকৃষ্ণ তার পা সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন অন্যথায় পরবর্তী বাণ তাঁর পা ভেদ করে নিচের পাতা ছেদন করত। এইভাবে অশ্বত্থ গাছের সমস্ত পাতা ছেদন করে তির ফিরে যায় বর্বরিকের তূণীরে।



শ্রীকৃষ্ণ বর্বরিকের অদমনীয়, প্রবল শক্তির অনুমান করতে পেরেছিলেন । এমতাবস্থায় তিনি তাঁকে এই যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে চাইলেন এবং ভিক্ষায় চাইলেন বর্বরিকের ‘মস্তক’। বিস্মিত বর্বরিক বুঝলেন এই ব্রাহ্মণ আর কেউ নন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণের হাতে মৃত্যু লাভ করে মোক্ষ প্রাপ্ত করা। আবেগে, আনন্দে অভিভূত বর্বরিক স্বেচ্ছায় নিজের মস্তক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্পণ করেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে নিজের চোখে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দেখার অন্তিম ইচ্ছাও প্রকাশ করেন।  শ্রীকৃষ্ণ সেই অনুরোধ রেখেছিলেন এবং বর্বরিকের ছিন্ন মস্তক জীবিত করে কুরুক্ষেত্র রণস্থলের সর্বাধিক উচ্চ স্থানে মতান্তরে একটি পাহাড়ে স্থাপন করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত দিব্য চক্ষু, কর্ণ দ্বারা বর্বরিক অবলোকন ও শ্রবণ করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।




মানুষের বিশ্বাস ‘চুল্কানা ধাম’ সেই পবিত্র ধর্মস্থল যেখানে বর্বরিকের ধড় রয়ে গেছে । কলিযুগে তিনিই শ্যাম রূপে পূজিত হন। মন্দির প্রাঙ্গণে আছে একটি অশ্বত্থ গাছ । দেখলাম সেই গাছ। অবিশ্বাস্য ভাবে সেই গাছের বহু সংখ্যক পাতায় ছিদ্র আছে। মহাভারত রচনা হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে কিন্তু এখনও এই মহাকাব্যের রহস্য আমাদের মনে আগ্রহ ও কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। মানুষ আজও বিশ্বাস করে এই সেই অশ্বত্থ গাছ যা মহাভারতের সময় বীর বর্বরিক তার তির দিয়ে বিদ্ধ করেছিলেন। 




মহাভারতের এক উপেক্ষিত বীর বর্বরিকের কাহিনী বয়ে নিয়ে চলেছে বিভিন্ন লোকগাথা । দূর-দূরান্ত থেকে অটুট বিশ্বাস নিয়ে এখানে ছুটে চলে আসেন অসংখ্য মানুষ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হন এই চুল্কানা ধামে। এখানে এলে বহুল প্রচলিত সেই প্রবাদ বাক্য সত্য হয়ে যায় ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’…










তথ্যঋণ- আন্তর্জাল 

দেহলিজ পত্রিকার জানুয়ারী ২০২৩ সংখ্যার জন্য আমার লেখার সঙ্গে পাঠানো চুল্কানা ধামের সব ছবি ও ভিডিও সবই  Samsung Galaxy A03s তোলা।  চুল্কানা ধাম, পানিপথ, হারিয়ানায়  18th December, 2022 তারিখে আনুমানিক দুপুর 1.30 PM  -3.30 PM সময়ের মধ্যেই  ছবিগুলি তোলা হয়েছে ।