দীপঙ্কর দত্ত প্রসঙ্গে

অগ্নি রায়



দীপঙ্করের বিরাস‍ : বাংলা কবিতার সাতটি দশক

আধুনিক বাংলা কবিতা প্রথম-প্রথম রেশ সহজ-সুগম ছিল, চল্লিশ আর পঞ্চাশের কবিরা এসে আঙুল ফাঁসিয়ে তার ন্যাড় আটকে দিয়েছেন। বিশ শতক আসার আগে ধাতব কলেজার কবিরা দুঃখবরণের তোয়াক্কা না করে বাঁকাস্রোতে খুব খেল দেখিয়েছেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যজগতে কিছু কিছু নতুন কুলক্ষণ পয়দা নেয়। এই নয়াল সেঞ্চুরিতে ঢুকে কবিরা দেখলেন কবিতা একটা চমৎকার জীবিকা হতে পারে। দুটো ডিকেড পেরোতে না পেরোতেই নানা খেপের বৃত্তি, খেতাব, পুরস্কার আর সরকারি ঝুনঝুনার ফাঁকতালে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বেশুমার মনোপলি শুরু হয় আর শতকরা পঁচাত্তর জন কবি এক-একটা ঘয়েলায় ঢুকে হাঁটুজলে দমাদ্দম লাথ ছুঁড়ে খুব বুলবুল্লা তুলতে থাকেন। পাঠকদের পাঠদাঁড়াও পাকচক্রে পালটি খায় এবং পো-নিৎসে-আইনস্টাইন সমর্থিত সাইকলিক দস্তুর মেনে বাংলা কবিতার গাড্‌ঢাযাত্রা শুরু হয়ে যায়। ভাবা যাক, ততদিনে যখন পশ্চিমী বিশ্বে টোয়েনটিজ-এর পেঁয়াজি হব্যাশ ছাই হতে লেগেছে, অলডাস হাক্সলি-লিটন স্ট্রেচিদের স্যাটায়ার, লরেন্সের লিবিডো, ভার্জিনিয়া উলফের মাইক্রোমোনিয়াল সেন্টুজালের ওপর দিয়ে নীল-বরফের কাত্রাবয়ে যাচ্ছে, এমন দিনে, তিরিশের সেই গোড়ায় একদিকে 'পরিচয়' আর অন্যদিকে 'কবিতা' – এই দুই ক্যানেলকে দস্তবরদারি করে বাংলা ভাষার মেইন স্ট্রিমের খাঞ্জা খাঁ কবিরা পদ্যের ছ্যাকরা হেঁকে চলেছেন ‘যৌবনবিভঙ্গ মোর উচ্ছ্বসিয়া গাহে কার গান' জাতীয় লিরিক-স্রোতে। উঠতি রাগী বেপরোয়া কবিরা পাত্তাই পাচ্ছে না ‘বিচিত্রা”, ‘ধূমকেতু’ আর কোরা-আনকা ‘দেশ’-এর কাছে। রবীন্দ্রছুটার দাপট তখনও গ্রাস করে রেখেছে ছিয়াত্তর জন কবিকে। বাকি দু-ডজন ‘নতুন’ কিছু করার তাড়ায় ফাটা বাঁশের সোর্ড ভেঁজে চলেছেন হিটলারি কেতায় : ‘প্রেমের আবীরে নয় – কবিতা রাঙাব দিয়ে বিধবার সিঁদুর' (বিভূতি চৌধুরী) ইত্যাদি। কেউবা হাতপটকা ছুঁড়ছেন : ‘কবিতা হবে আগামী কালের সত্য, এ যুগের মিথ্যাচার নয়' (হরপ্রসাদ মিত্র) – এই পিটিশনে। তখন সুভাষ মুখুজ্জে, জগন্নাথ চক্রবর্তীরা লিখতে শুরু করেছন বটে, কিন্তু বড্ড কাঁচা, – 'তনুর তীরে দেখিছ নাকি কামনা মায়ামৃগ / কাজল চোখে দিতেছে হাতছানি, / ব্যাধের বাণ পিছুতে কাঁপে জানি ও মরমী গো / তাহারে লয়ে কাননে কানাকানি।' (সুভাষ )

তিরিশের দশকে সবচেয়ে ধ্যানভঙ্গ-এন্ট্রি দিনেশ দাসের – ‘ধ্যানমৌন তপস্বীর তপোভঙ্গ হল আজ বহুদিন পর / বর্ষণের মত্ততায় রুদ্র সুরে আত্মভোলা জেগেছে শঙ্কর / দুরন্ত উল্লাসে যেন' – সাঁইত্রিশ সনে যাঁর ‘কাস্তে’ গনগনিয়ে দিয়েছিল বাংলার গন্ধবাহ। অবশ্য, বাংলা কবিতার তৃণপ্রতিম বাঁকবদলও ‘কাস্তে’ ঘটাতে পারেনি। নরেন মিত্তির, হরিনারান চাটুজ্জে, নারান গাঙ্গুলিরা হাফ ডিকেড ধরে 'কাব্যপ্রলাপ’ উগরে উগরে হাবজা কবিতার আলবাটি বানিয়ে ফেলেছিলেন। ‘পৃথিবী না প্রেতলোক মাঝে মাঝে হতেছে সন্দেহ' (অশোকবিজয় রাহা) – এমনতর মাচিশ-পংক্তি লিখনেঅলাদের দেখা মিলছে ক্বচিৎ । তরে মিলতে অবশ্যই লেগেছে। ‘ঘুঙুরের বোলে মদালস দিনগুলি / মিলনোন্মুখ কিশোরীর মত হল’ (কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) ঐ সময়েই লেখা। বাংলা কবিতার আড়ায় একদিকে পদ্যপ্রলাপের বদমাংস জমে জমে একশা, ফের অন্যদিকে মেদ ঝরিয়ে, উপমা, প্রতীক, আঁশ ছাড়ানো শব্দবন্ধে নিপুণ নিটোল তন্বী করে তোলার তষ্টি-তদ্বির।

তারপর বোমারু বিমান আর মন্বন্তরের দিনগুলো এসে গেল — ১৯৩৯-৪৫ – একটু বাদেই দাঙ্গা। কবিতাও ঢুকে পড়ল কাশিদাপাঠের মজলিশে। হুঁচোট খেল ক্রিয়েশান, খানিক বাট লেগে গেল কবিতার ছ্যাকরাযাত্রায়। বীরু চাটুজ্জেদের খুনে-খরশান চাকু খুব চমকাতে লেগেছে, দিনেশ দাসের মুঠোয় ক্রান্তির ফিনকি। এহেন অপদিনে অসীম রায়, পরে যিনি ধুরন্ধর ঔপন্যাসিক হবেন, রবীন্দ্রনাথকে লেখা গান্ধীবাবার একটি চিঠির প্যারোডি বানাতে গিয়ে বাংলা কবিতার ভিরি আর্জিটাই গোটাগুটি বয়ান করে দিলেন : ... কোটি কোটি প্রাণে আজ কি অশান্ত মত্ত ব্যাকুলতা, / আজ তারা চাহে শুধু অন্ননাম্নী একটি কবিতা।’ আর, কী আশ্চর্য, এর পরপরই বাংলা ভাষায় দুজন আদিম দেবতা সত্যিসত্যি ‘অন্ন-নাম্নী’ কবিতা নিয়ে চলে এলেন। তাঁদের একজন অমিয় চক্রবর্তী, অন্যজন জীবনানন্দ দাশ। দেশ যুদ্ধ দাঙ্গা মন্বন্তর এক লপ্তে ভ্যানিশ হয়ে কবিতায় এলো কবিতার নিকষ দ্যুতি। বিশেষত জীবনানন্দ, ঐ ছিল নোডাল পয়েন্ট; বাংলা কবিতায় যে একটা ভারি-ভরকম তত্তাপলট ঘটতে চলেছে – তার পাতবিন্দু। মৃত্যুর পরে নয়, এমনকী, তার আগেই জীবনানন্দকে চিহ্নিত করা হয়েছিল এইবলে যে, ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে জীবনানন্দের দানই সবচেয়ে অসাধারণ ও কৌতূহলোদ্দীপক।' কী আশ্চর্য, একজন হেরো, পরাক্ত পুরুষের ত্রাস- নির্বাপিত নিষ্প্রাণ ও নিস্তেজ জ্বালা, তথা একাকীত্ব ও নভাক যামিনীর প্রতি মর্মান্তিক স্যারেন্ডার থেকে নতুন ফুয়েল পেয়েছে নির্বাপিতপ্রায় বাংলা কবিতার দীপশিখা। এ ভারি অদ্ভুত, বড়ই শ্রদ্ধার। হিমশীতল অবসাদ আর তুষাগ্নি বিষাদ থেকে জীবনের নতুন ফিটাস।

দেশভাগ হলো, অর্থাৎ 'স্বাধীনতা'। বাংলা কবিতার উত্তরণের চাকা আরেক দফা গাড়ায় পড়ল। সিংহভাগ কবি মেতে উঠলেন ‘শহীদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। অল্প আগের বতা নিয়ে সমালোচক অরুণকুমার সরকারের মন্তব্য ছিল : '১৯৪১-৪৫-এ বাংলা ভাষায় যতগুলি কবিতা লেখবার চেষ্টা হয়েছে তার মধ্যে শতকরা সতেরোটি পদ্যই, যদি-না আরো বেশি, আজ ধূলিমলিন সংবাদপত্রের তুল্যমূল্য।' অরুণবাবু মোটে সতেরো পারসেন্ট আর ১৯৪৫-এ কেন সীমা টানলেন বোঝা মুশকিল। এ- কথা স্বচ্ছন্দে প্রযোজ্য ছিল স্বাধীনোত্তর কালের কবিতা সম্পর্কেও। এমনকী, পঞ্চাশের বেশির ভাগ কবিতা দেখলেও এ-দৈন্য আরও বিকট হয়ে ওঠে। অবশ্য পঞ্চাশ বিষয়ে আরও 'কথা' আছে।

পঞ্চাশে বাংলা কবিতায় লেগেছে হালকা চালের রোমান্টিক সুর – ‘এখন এসেছে ধান কুড়াবার ধুম / সোনা ফলা মাঠে আমাদের অধিকার' (রাম বসু)। "খুব সুন্দর, না? / এই যে বিকেল, সূর্যের হাতে প্রসাধিতা লাল / বর্ণা'। (বটকৃষ্ণ দে) তখন নতুন কবি মাত্রেই রোমান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা- তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম – দেবদাস পাঠক : 'এখানে মিঠেল হাওয়া, সমুদ্র না জানি কতদূর, / সন্ধ্যায় কার্জন পার্কে শুনি তবু সমুদ্রের সুর। পুরনো নামী কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দ চক্রবর্তী, দিনেশ দাসদেরও খুব বোলবালা। ওদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা, দেখতে দেখতে কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে : এ পথের বাঁকে দাঁড়ালে কখনো একদিন যেত শোনা “একটি নদীর মন-কেড়ে নেওয়া সুর, / মনে হতো বাজে সেতারের মতো। তবু কেউ জানতো না / নদীর মোহানা অনেক দূর।' (অলোকরঞ্জন) ..... এধার ওধার থেকে রটানো হতে লাগল যে সুদিন ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজির সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে বাপস্ আসছে নতুন দ্যুতি।

আসল ঘটনা ছিল বিলকুল উলটো। আদতে, এই ছিল টার্নিং পয়েন্ট যেখান থেকে বাংলা কবিতা পাঠক হারাতে লেগেছিল। যুগপৎ সুদিন আর দুর্দিন – বিশ্বের আর কোনো ভাষার কাব্যজগতে এমনতর বিচিত্র ঘটনা সম্ভবত ঘটেনি। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণ আচার্যদের আসরে নামতে তখনও সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিয়েছেন : 'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' র‍্যাশনাল এনজয়মেন্ট-এর নতুন খবর। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা ফাটিয়ে দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার আঙ্গিক আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতায় ক্র্যাকের দাগ দগদগে হয়ে দেখা দিতে থাকে। আর আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের দুব্বো ঘাষে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা ভাবলেন বাংলা কবিতায় ‘প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গী। কিন্তু এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিশেবে দেখা দিল পাঠ্য- পাঠকের সেই জগদ্বল সমস্যা। সমস্যাটা যে ধাঁই ধাঁই হারে বাড়তে শুরু করেছিল সেটা ধরাও পড়ে যায় ‘আরও কবিতা পড়ুন' ফেস্টুন হাতে চৌরঙ্গীর পথচারীদের কাছে চল্লিশের কবিদের হাত-পাতা আখুটিতে। বিষয়ের গরিমা বাঁতায় ফুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের দিকে মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁকের ফল যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন বুঝতে পেরেছিলেন কেউ কেউ। সময়টা ঠিক ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।

ফলে, অনিবার্য ভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়চিহ্ন নয়, সময়ের গতরে যাট ছিল একটি পিরেনিয়্যাল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্স্ক – সত্তরে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায়, বিশেষত পঞ্চাশের ন্যাকাচিত্ত লিরিকবাজি আর কলাকৈবল্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাট-সত্তরের ঐ হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছে কলকাতা। ন্যাকানাদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুব্বো-ধুনো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে গাঁজাখোর চরসখোর তাড়িখোর রেণ্ডিবাজ কবিদের তীব্র সাবঅলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিল্মী কারকিতে। ছোটলোকদের ঐ ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লীন সেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল এইভাবে যে, 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে' (শঙ্খ ঘোষ)। এবং, বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এতে- করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় এক লপ্তে।

আশি : দীপঙ্করের চারপাশ

আশির দশকের সূচনালগ্ন মামুলি ‘সন্ধিক্ষণ' ছিল না। এর আগে পর্যন্ত বাঙালির সমাজ ও জীবন সংক্রান্ত ভাবনাগুলো যে খাতে বয়ে আসছিল, – সেখানে সারা ভারতভূম জুড়ে পলিটিকাল ডামাডোল ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হুড়দঙের মাঝে, বঙ্গ কালচারের পীঠস্থানে হটাহট বাম রাজনীতির শুরুয়াৎ এবং তজ্জনিত বহুবিধ উলটফের, ১৯১৭ থেকে দেখে আসা কমিউনিস্ট ক্রান্তির স্বপ্ন গর্বচভে এসে চুরমার, টিভির আগের প্রজন্ম ও পরের প্রজন্ম— বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘জেনারেশন নেক্সট’, এবং তথ্যপ্রযুক্তি তথা সাইবার বিস্ফোরণে মূল্যবোধের বিশ্বায়ন ঘটে যাওয়া – এসবের সম্মিলিত এফেক্ট হিন্দী ফিল্মের প্যারালাল আর মশলাদার ফিল্মের ক্র্যাকের মতো একটা মোটা দাগ খিঁচে দিয়েছিল আশির দশকে। আশি আর

তার পরের বাংলা কবিতার চিড় ফাড় করতে হলে এই প্রেক্ষিতটাকে আলচা-চোখে নজর রাখতে হবে। যদিও কলকাতা কেন্দ্রিকতার বহুধ্বংসী সমস্যাটা থেকে মুক্ত থাকতে হবে তারও আগে।

আশির দশকের লেখাপত্রে এমন কিছু পর্যায় আছে যার দরুন চলে আসা এঁদো কাব্যযাত্রার সাপেক্ষে কেউ কেউ সিদ্ধি পেয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে চটসে যাঁদের নাম মনে পড়ছে, এবং কবি ও সুললিত গদ্যের প্রবন্ধকার স্বপন রায়ের ভাষায় যাঁরা “বিগত দিনে বিদ্যুৎপ্রভ আকাশিয়ানা থেকে নতুন চেতনায়, দ্যুতিময় নীলাভে যেতে চেয়েছেন এবং অংশত সফলও হয়েছেন, তাঁরা অলোক বিশ্বাস, জহর সেনমজুমদার, ধীমান চক্রবর্তী, নাসের হোসেন, নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, মল্লিকা সেনগুপ্ত, রঞ্জন মৈত্র, রাহুল পুরকায়স্থ, শুভঙ্কর দাশ, শ্রীধর মুখোপাধ্যায়, স্বপন রায় ইত্যাদি। এঁদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে দশকের নিজস্ব হিসেরেও দেখা যেতে পারে। কারণ আশির দশকের কবিতার সমস্ত পেরেকচিহ্ন ধারণ করে রয়েছে মূলত এঁদেরই জীবনরোধ, মেধা, পাঠ, দার্শনিক অবস্থান, প্রজ্ঞা এবং প্রতিভা। অধুনান্তিক লিরিকহীনতার মধ্যে লিরিকতার 'নতুন চেতনা এবং পুরনো শব্দের মেলবন্ধনে এঁদের লেখাপত্র হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারা।

নতুন ‘ধারা’, কিন্তু নতুন একটা ‘অধ্যায়' গড়ে তুলতে পারেনি মুষ্টিমেয় এই ডজনের কবিতাচর্চা। যেখানে শব্দ দিয়ে কবিতা তৈরি হয়, তাই নতুন চেতনার জন্য নতুন শব্দেরও প্রয়োজন। পুরানো শব্দের অপরীক্ষিত ব্যঞ্জনা দিয়েও নতুন কিছু তৈরি করা যায়, কবি বারীন ঘোষাল যাকে বলেছেন শব্দের ‘অসম্ভব ব্যবহার; – কবি যখন প্রচলিত রীতি, ছন্দ-প্রকরণ এবং শব্দ শরব্যতায় শৃঙ্খলিত বা আন-ইজি বোধ করেন, তখনই নতুনের জন্য এই যাচনা জন্মায়, নতুন কবিতার জন্ম হয়। কিন্তু আশির সিংহভাগ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিদের লেখাপত্রে এই 'নতুন'-এর খাস নমুনা নেই। এঁদের কারণেই এখন বাংলা কবিতার পাঠক আরও কমে গিয়েছে। পাঠকরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন ঐ সিংহভাগ কবির কবিতা থেকে, যেখানে নিরূপিত ছন্দে ঝকাস্-ঝকাস্ অন্ত্যমিল দিয়ে মধ্যবিত্ত ভাব-ভালবাসা-রাজনীতি-সমস্যা-রোমান্স-স্থূল আবেগের কথা বলা হচ্ছে। কখনো সামান্য সূক্ষ্মভাবে, কখনো একেবারেই গভীরতাহীন ‘স্মার্টনেস' সহ। আর, দোষের দায়ভারটা অযথা লেপটে যাচ্ছে আশির দশকের সমস্ত কবির সঙ্গে। মানে, আহত হবার মতো যেটা, — ষাটের তিনুকমিজাজ শক্তমুঠোর কবিরা বাংলা কবিতায় ফর্ম আর কনটেন্টে যেসব ফেরাফিরি আর তরমিম আনলেন, মাঝের একটা দশক সাবাড় হতে না হতেই ফের পেটআঁটা কনস্টিপেশান ।

এটা ঠেকনো দেওয়া একরকম অসম্ভবও ছিল। আজ বিশ্বায়ত মিডিয়ার সর্বগ্রাস আর দিনমানের স্পিড আমাদের বাধ্য করছে জীবনের তাবৎকিছুকে খবর-চলাকালীন তলায় বহমান হেডলাইন স্ট্রিপের মতো করে দেখতে। জাগতিক সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে মেন্টালি বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর কোনো কিছুতেই ইনভলভড হওয়া পুরোপুরি বানচাল হয়ে গ্যাছে। এরই অনিবার্য পরিণাম আজকের বাংলা কবিতার অনগিনৎ উপস্থিতি, যা শতাধিক টিভি-চ্যানেল তথা সহস্রাধিক মোবাইল টোনের ট্যাঁ-ট্যার মাফিক থ্রি হানড্রেড সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন ওয়েব সাইট ন্যাভিগেশানের আরূঢ় প্লুরালিজমের আড়ালে শব্দের ওপর শব্দ চড়িয়ে শব্দের ক্রসব্রিড ঘটিয়ে একেবারে স্টিল প্রিভেইলিং কন্ডিশানে পয়দা পাচ্ছে এক-একটি ন্যাকান্যাতা কন্ডোম- পিচ্ছিল ঘোমটানো ঘরানার মাদি কবিতা। শাসনতন্ত্রের দমনকেতার সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করে সাহিত্যের গিনাচুনা মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গাঁ-গঞ্জ, জিলা-মহকুমা আর শহুরে ইউনিভার্সিটি থেকে তাজা-তরকা ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে কবিতা ছাপানোর নামে ভ্যাসেক্টমি করে ছেড়ে দিচ্ছে বাজারে। তারা এখন স্রেফ শব্দ খায়, শব্দ হাগে, শব্দের চিনেপটকার পোঙায় ধূপকাঠি ধরে শব্দ সেলিব্রেট করে। এদের যে-কোন একটি চার ফর্মার কবিতার বই বিশ মিনিটের মাথায় হাত থেকে খসে রদ্দির বীনে সর্বদার নিমিত্ত থির হয়ে যায়।