ইবন-এ-মারিয়াম

 

--প্রসেনজিত দাশগুপ্ত

 

________________



- "মির্জা গালিব হাজির হো!"



কোন সাড়া আসেনা। নিস্তব্ধ কোর্টরুম। যেন একটা সূঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। দণ্ডধারী আবারও হাঁক পারে।



- "মির্জা অসদৌল্লাহ বেগ গালিব হাজির হোওওও!"



অনাদি শূন্য থেকে হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ আলো, নেমে আসে সরাসরি কাঠগড়ায়। ঝিকিয়ে ওঠে এজলাস। সকলে চমকে ওঠে।



এক দীর্ঘদেহী মানুষ, পক্ককেশ, সাদা শ্মশ্রুগুম্ফময় শান্ত মুখমণ্ডল, গায়ে খানদানি কেতাদুরস্ত জোব্বা, মাথায় পেশোয়ারি টুপি, দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সপ্রতিভ একজোড়া চোখ মেপে নিচ্ছে কোর্টরুম। সে দৃষ্টিতে শিশুসুলভ সারল্য৷



- "মাফ করবেন খোদাবন্দ! আসতে একটু দেরি হল। দেড়শো বছর পেরিয়ে আসতে ওয়াক্ত তো লাগে..."



- "আপনিই গালিব?" শুধোন বিচারক।



- "জি হুজুর! গালিব এই না-চিজ্ এরই নাম!" মাথা ঝুঁকিয়ে বলে সেই আগন্তুক - "হুজুর কষ্ট করে সমন পাঠিয়েছেন, বলুন কী করতে পারি?"



- "আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে, তা জানেন?"



- "শিকায়ৎ আমার নামে?" চমকে ওঠেন গালিব - "ইয়া খুদা, সজ্ঞানে কোনও গুনাহ তো আমি করিনি কখনও, পাক-পর্বরদিগারের কাছে নিজের যা কিছু অভিযোগ-অনুযোগ জানাই, তিনি ম্যহেরবান...কিন্তু অন্যায় করিনি কখনও, বুঝতে পারছি না কী এমন করলাম যার জন্য, হুজুর ডেকে পাঠালেন?"



- "দেখুন তো, এই গজল কী আপনার লেখা?"



হাতে একটি কাগজ তুলে নিয়ে, মহামান্য বিচারক, গলা খাঁকরে যতটা সম্ভব সুর করে পড়তে থাকেন।



["ইবন-এ-মারিয়াম হুয়া করে কোই

মেরে দুখ কী দবা করে কোই..."]



- "জি হুজুর! এটা আমারই লেখা...খুব প্রিয় নজ্ম"



- "খামোশ!" ধমক দিয়ে ওঠেন বিচারক - "এসব কী লিখেছেন আপনি? এর জন্যই যত সমস্যা..."



- "সমস্যা? এত সামান্য গজল! কী এমন লিখেছি হুজুর, যার জন্য এত বড় 'গুনাহ' হয়ে গেল?" কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করেন গালিব।



- "আপনি তো শিয়া, সাচ্চা মুসলমান! তা এসব কী লিখেছেন? 'ইবন-এ-মারিয়াম'? শেষে কিনা বেহায়া কেরেস্তানিদের দলে ভিড়লেন? তওবা তওবা!"



- "কিন্তু খোদাবন্দ!" গালিব যেন ডুকরে ওঠেন।



- "কোনো কিন্তু না, আপনি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছেন। 'গুনাহ-এ-আজিম'-এর চাইতেও বড় গুনাহ, মুসলিম হয়েও কিনা খ্রিস্টানদের নিয়ে গজল লেখা! হজরত (সাঃ) কে নিয়ে না লিখে হঠাৎ যিশুকে নিয়ে কাব্যি, দেখাচ্ছি মজা!" ক্ষেপে ওঠেন বিচারক।



- "হুজুর, অপরাধ নেবেন না! আমার কাছে তাঁরা সবাই এক ও অভিন্ন, আমার একান্ত আশ্রয়, পরম করুণার আলো...আমার চোখ দিয়ে দেখুন হুজুর, আপনিও বুঝতে পারবেন" - যেন কোন মায়াঘেরা সপ্তম স্বর্গ থেকে ভেসে ওঠে গালিবের কণ্ঠধ্বনি।



*



অ্যান্টি ন্যাশনাল গালিব।



বছর পাঁচ-ছয়েক আগে, রাজধানী দিল্লিতে সাড়া ফেলেছিল এই নাটক। শুধু নাটকের নাম-ই নয়, তার বিষয়বস্তুও এমন অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী যা রীতিমত ঝড় তুলেছিল বিদ্বজ্জন মহলে।



জামিয়া মিলিয়ার গণমাধ্যম বিভাগের অধ্যাপক, প্রখ্যাত নাট্যকার দানিশ ইকবালের 'স্যাটায়ার'ধর্মী এই 'কোর্টরুম' ড্রামার বিষয়বস্তু - উর্দু সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ মির্জা গালিবের একটি গজল যা ঈশা মাসীহ বা যিশুর উদ্দেশ্যে অর্পিত, তাকে কেন্দ্র করে।



নাটকে দেখা যায়, এক চলচ্চিত্রকার তার প্রতিদ্বন্দ্বী চলচ্চিত্রকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকেছেন, ছবির গানে একটি চরম 'আপত্তিকর', 'অভিসন্ধি' ও 'উস্কানিমূলক' একটি গজল ব্যবহার করবার জন্য।



সেই নির্দেশকের অভিযোগ যে, 'ইবন-এ-মারিয়াম' শীর্ষক গজলটি নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে; শুধু তাই নয়, এই মহান দেশের হাজার বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য ও পরম্পরা প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ গজলটির লেখক এক দেশদ্রোহী, তাই তার কঠোর সাজা হওয়া উচিত।



আদালত (ক্যাঙারু কোর্ট বলা বেশি ভাল) তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে 'হাস্যকর' ভাবে সরাসরি রচনাকার মির্জা গালিব-কেই তলব করলে; আত্মপক্ষ সমর্থনে ও আদালতের ডাকে সাড়া দিয়ে, ইহকাল-পরকালকে পিছনে ফেলে আদালতে উপস্থিত হন মির্জা। কেন তিনি যিশুকে নিয়ে লিখেছেন তার দীর্ঘ ব্যাখা দেন। একইসঙ্গে তুলে ধরেন মতপ্রকাশের অধিকার ও তাঁর সিদ্ধান্ত।



*



ভাবতেও অবাক লাগে, প্রায় ১৬০/১৭০ বছর আগে, এক দিব্যোন্মাদ মুসলিম শায়ের, পুরানি দিল্লির গলি কাসিম জান, বল্লিমারানে বসে একটা আস্ত গজলই লিখছেন, উৎসর্গ করছেন 'নাজারেথের যিশু'-কে।



তার প্রতিটি ছত্রে যে আকুতি, ঐকান্তিক সমর্পন ও 'রাজার রাজা'র প্রতি সেই অনিঃশেষ প্রেমস্পদের বাসনা, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। উর্দু সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল।



মির্জা গালিবের পরবর্তীতে ক্লাসিকাল উর্দু সাহিত্যের পৃষ্ঠভূমিতে সুফিবাদের সূত্রে অপার্থিব ধর্মাচরণ ও তার গন্ডি ডিঙানো বিচ্ছুরণ দেখা গেলেও গালিবের 'ইবন-এ-মারিয়ম' তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি, অথচ খুব মানুষ-ই এই রচনাকে মনে রেখেছেন।



আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি (বেগম আখতার), কে এল সেহগল, জগজিৎ সিং, আবিদা পারভিন বা উস্তাদ নাজিম হুসেইনের কণ্ঠের জাদুতে মির্জা গালিবের এই বিরল 'খ্রীষ্টগীতি' তার সার্থকতা খুঁজে পেলেও; গজলটির অন্তর্নিহিত দর্শনের আলোয় সন্নিহিত যাপনচিত্র ও সর্বোপরি সহজিয়া সারতত্ত্ব যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে, তা বোধকরি এক অজানা গালিবের সন্ধান দেয়, খুদা-ই-রহমত, যাকে আজও চিনে উঠতে পারিনি আমরা।



বড়দিনের পুণ্য লগ্নে মির্জা গালিবের সেই অভূতপূর্ব রচনাটির তর্জমা তুলে ধরার চেষ্টা রইল৷



দোষত্রুটি মার্জনীয়।



____________



ইবন-এ-মারিয়াম হুয়া ক'রে কোই

মেরে দুখ কী দবা ক'রে কোই (১)



[যিশুর (মারিয়াম পুত্র) মত যদি কেউ হতো

আমার দুঃখের কী উপশম হতে পারত?]



শ্যরা-ও-আইন পার মাদার সহী

অ্যায়সে কাতিল কা কেয়া ক'রে কোই (২)



[এমন আইন-শাস্ত্র বহাল থাকলেও বা কী

যে আমার ঘাতক, তাকে কী সাজা দেব?]



চলে জ্যায়সি কড়ি কমান কা তির

দিল মে অ্যায়সে কে যা ক'রে কোই (৩)



[তূণ থেকে উড়ে আসা তিরের মত এসে

আমার হৃদয়ে কেউ তার আশ্রয় খুঁজে পাক]



বাত পর বাঁ জুবান কট্ তি হ্যায়

উহ ক্যহে ঔউর শুনা ক'রে কোই (৪)



[কথায় কথা বাড়লে জিভ কাটা পড়ে

সেই বলুক, আর বাকিরা শুনুক না'হয়]



বক্ রহা হুঁ জুনুন মে ক্যায়া ক্যায়া কুছ

কুছ না সমঝে খুদা ক'রে কোই (৫)



[কী নেশায় বলে চলেছি এসব ছাইপাঁশ

প্রভু, যেন সে সব কেউ বুঝতে না পারে]



না সুনো গ্যর বুরা ক্যহে কোই

না সুনো গ্যর বুরা ক'রে কোই (৬)



[শুনো না যদি কেউ খারাপ কথা বলে

শুনো না যদি খারাপ করে কেউ]



রোক লো গ্যর গলত চলে কোই

বখশ দো গ্যর খতা ক'রে কোই (৭)



[ভুল পথে গেলে কেউ তাকে থামাও

ক্ষমা করে দাও, ভুল করে যদি কেউ]



কৌন হ্যায় জো নেহি হ্যায় হজত্ মন্দ

কিস কি হজত্ রওয়া ক'রে কোই (৮)



[এমন কে রয়েছে যে অভাবী নয়

কার অভাব দূর করতে পারে কে?]



ক্যয়া কিয়া খিজর্ সিকন্দর সে

অব কিসে র্যহনুমা ক'রে কোই (৯)



[আলেকজান্ডারের সঙ্গে কী করেছিল খিজর্

কে আর হবে কারুর পথপ্রদর্শক?]



জব তব্বকু হী উঠ গ্যয়ে 'গালিব'

কিউ কিসি কা গিলা ক'রে কোই (১০)



[যখন সব প্রত্যাশাই শেষ হয়েছে, গালিব

কারুর বিরুদ্ধে কার কিসের অভিযোগ?]



ইবন-এ-মারিয়াম হুয়া ক'রে কোই...