নন্দিতা সাহা
Author / Editor : নন্দিতা সাহা

দুটি টাকা
নন্দিতা সাহা
"এই রবি আমাকে দে , রবি আমাকে দে , আমি আগে এসেছি , রবি দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু , রবি আমি কিন্তু সব ভেঙ্গে ফেলবো , রবি বেল বাজল বলে , রবি আজ যদি তোর জন্য বকা খাই না দিদিমণির কাছে !! তারপর দেখবি তোর ঠেলা গাড়ির টায়ার পাংচার করে দেব ! "
এতগুলো ছোট ছোট অবুঝ মেয়ের দাপাদাপি রবির মুখের সামনে , তবু রবি অস্থির হয়না , অধৈর্য হয় না | সবাইকে যার যার পছন্দের জিনিস টি দেয় | মাত্র আধ ঘণ্টা চলে এই তুমুল হট্টগল | রবিকে চারিদিক থেকে যেন ভিমরুলের মত ছেঁকে ধরে ! তারপর বেলটা বাজলেই নিমেষে একেবারে খালি হয়ে যায় | রবি তখন বটগাছের তলায় বসে জিরিয়ে নেয় | আবার স্কুল ছুটির সময় কিছু বিক্রি-বাট্টা হবে খন |
" মা সারদা বালিকা বিদ্যালয় " | তারই সামনে এক কোণে রবি ওর ঠেলাগাড়ি নিয়েই বসে থাকে | কি নেই ওরা গাড়িতে ! পাকা তেতুল ! চালতার আচার ! পপিন্স !লেবেঞ্চুস | ডালমুট ! ঝাল মুড়ি ! শোনপাপড়ি ! লেড়ে বিস্কুট ! সবকিছু কাচের বয়ামে সাজানো থাকে | স্কুলের অল্প বয়সী মেয়ে গুলো ওকে ছেঁকে ধরে | কেউ রবির হাত থেকেই পায় , কেউবা ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে চলে যায় কোনও রকমে পয়সাটা দিয়ে | কেউ কেউ আবার চোখ পাকিয়ে বলে , রবি এত ঝাল কেন দিয়েছিস ! রবি হাসি হাসি মুখ করে আবার বানিয়ে দেয় | ওদের দুষ্টুমি রবির চোখ এড়ায় না | বছরের পর বছর এই কাজই করছে রবি | ভালোই লাগে | সংসারটাও চলে যায় |
রবি নজর করেছে , একটি মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে | মনে হয় নতুন | সবার থেকে একটু আলাদা | চেহারায় ধনী ঘরের ছাপ | পরিষ্কার ধবধবে ইউনিফর্ম | মেয়েটি দুই একবার বার চেষ্টা করেছিল ভিড়ের মধ্যে ঢোকার , কিন্তু এমন দাপুটে হাতের কাছে হার মেনেছে | ওর মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব | তেমন সহজ হতে পারে না | রবি বোঝে মেয়েটা সবার থেকে অন্যরকম বৈকি | মোটেই দামাল নয় , দস্যিপনা ওর কম্ম নয় |
রবি নিজেই জিজ্ঞেস করে , দিদি তোমার কি চাই ? নীলা বলে দেয় | রবি ওর কাগজের তিনকোনা ঠোঙায় করে গুছিয়ে রেখে দেয় , তারপর সুযোগ বুঝে, দিদি এই নাও বলে হাতে গুজে দেয় | রবি জানে এই শান্তশিষ্ট মেয়ে টি ওই ডাকাবুকো মেয়েদের সাথে পেরে উঠবে না মোটে |
রবি 50 বছরের মাঝবয়সী | তবে কাঁচাপাকা চুলে বয়সটা অনেক বেশি দেখায় | তবুও ওই কচিকাঁচারা সবাই রবিকে তুই-তোকারি করে | কারো দ্বিধা হয় না | রবির তাতে কোনো আপত্তি নেই, বেশ ভালোই লাগে | ও যেন ওদের বন্ধু হয়ে যায় |
কিন্তু নীলা পারেনা | ওর বাড়ির শিক্ষাদিক্ষা ওকে সবার থেকে একটু অন্যরকম বানিয়েছে | মা বলে , বড়দের তুই-তোকারি করবি না সে যেই হোক না কেন ! মুচি মেথর হলেও না | যে বয়সে বড় তাকে সবসময় সম্মান করে কথা কইবে | নীলা রবিকে , রবিদা বলে ডাকে | রবির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে | মনটা ভরে যায় |
মাঝে মাঝে রবির ছেলে চুপটি করে বসে থাকত রবির পাশে | নীলাকে দেখে কইতো , ওই মাইয়া ডা বড় লোকের বেটি | নীলার বড় লজ্জা করে | নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখত | একদিন অবশ্য রবিকে দেখে নীলা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল | রাগে চোখ লাল , কপালের শিরা ফুলে উঠছে , ছুটে গিয়েছে রবি | এই সা হাত টেনেছে ! হাত একেবারে মটকে দিয়েছিল লোকটর | লোকটা নাকি এমনি এমনি রবির ছেলেকে এক থাপ্পড় মেরেছিল | ব্যাস ! আর যায় কোথায় ! সত্যি সন্তানের জন্য বাবা কি না করতে পারে ! রবি সব ভুলে গিয়ে লোকটার হাত কট করে মটকে দিল | একেবারে রিভেঞ্জ ! রবির সেই রুদ্রমূর্তি এখনো নীলার চোখে স্পষ্ট | বাপরে এত রাগ রবির !! না দেখলে বুঝাই যায়না , ভাবাই যায় না|
,
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আবার সেই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নীলা | স্কুল ছাড়ার পর কলেজ | তারপর বিয়ে | খুব শিগগিরই বিয়ে হয়ে গেছিল | বরের হাত ধরে দূরে , দূরে, অনেক দূরে চলে গিয়েছে | এখানে, সেই ছোটবেলার জায়গায় আর ফিরে আসা হয়নি | দুম করেই বিয়েটা হয়ে গেল | ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগে একবার স্কুলে এসে ঘুরে যাবে কিন্তু তাড়াহুড়োয় সে আর হয়ে ওঠেনি | বড় দিদিমণি অবশ্য ওকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল | লিখেছিলো, " সারা পৃথিবীতে ডানা মেলে উড়ে বেড়াও, খুব সুখী হও | তোমার ঝকঝকে পরিষ্কার স্বচ্ছ মনটা যেন ঠিক একই রকম থাকে | সত্য পথ ছেড়ো না | " আজও সেই চিঠি যত্ন করে বিয়ের অ্যালবামে রেখে দিয়েছে নীলা | পঁচিশ টি বছর পরে , এই ছোট্ট পাড়া গাঁ জন্মভূমিতে এসেছে নীলা | ইচ্ছে ছিল একবার স্কুলটাকে প্রণাম করে যাবে, কারণ স্কুল নীলার কাছে ঠিক যেন মন্দির , তীর্থক্ষেত্র |
মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীলা | ঝাঁ চকচক করছে ওর "সারদা বালিকা বিদ্যালয় " | স্কুল এখন তিনতলা হয়েছে | চারিদিকে সাজান গোছানো গাছের সারি | সামনে পেল্লাই গেট | প্রাচীর | আগে তো এতসব কিছু ছিল না | বোঝাই যাচ্ছে স্কুলের অনেক উন্নতি হয়েছে , স্কুলের জৌলুস বেড়েছে | নীলা খবর পায় , এই স্কুল থেকে নাকি এখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করে !! গর্বে মনটা ভরে যায় নীলার |
মেয়েকে নিয়ে ঢুকলো স্কুলে | সে ---- ই সেদিনের দিনগুলো চোখের সামনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল | প্রথম যেদিন এসেছিল ক্লাস সেভেন এ , সেদিন ছোট্ট একটি গেট দিয়ে ঢুকে ছিল | স্কুলে ঢুকে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল ! কেমন হবে দিদিমণিরা ! ও তো নতুন এসেছে !! ক্লাস এর মেয়েরা কেমন হবে ! আজ কিন্তু মোটেও ভয় নেই নীলার | আজ শুধু আনন্দ আর অদ্ভূত এক শিহরণ |
নীলা অফিস এ জানাতেই , কেউ একজন গিয়ে হেডমিস্ট্রেস কে খবর দিলো | প্রাক্তন ছাত্রী এসেছে শুনে হেডমিস্ট্রেস নিজেই এগিয়ে এলেন | সাদরে নিয়ে গেলেন ভেতরে | ততক্ষণ প্রার্থনার জন্য ছাত্রীরা তৈরি | খুব ভালো সময়ে এসেছে | স্কুলের সেই মাঠ ! সেই চৌকো মাঠ এখনো একই রকম আছে বরং জৌলুস যেন আরও বেড়েছে | চারিদিকে সবুজ | মনে পড়ল ওরা একবার পনরই আগস্ট এ বৃক্ষরোপণ করেছিল | আহা সেই গাছ গুলোই বুঝি বড় হয়ে স্কুল কে একেবারে সবুজে ভরিয়ে দিয়েছে |
স্কুলের প্রত্যেকটি ছাত্রী মাঠে ঠিক সে --ই রকম লাইন করে দাঁড়িয়েছে | প্রার্থনার জন্য সবাই হাত জোড় করে আছে | | সবার সাথে নীলাও দাঁড়িয়ে পড়ল | দুই হাত জোড় করে গাইল , "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে "|
নীলা র মনে পরল সেই সময় নীলার সাথে থাকতো শ্রাবণী , দুর্গা , চুমকি , শুক্লা, গার্গী, মৈত্রী , কেকা | সবাই একসাথে লাইন করে ক্লাস থেকে আসত | ওরা ভারি দুষ্টু ছিল !! কেউ গাইতো না | চোখ মিটমিট করত আর ঠোঁট দুটো একটু নাড়াত | ক্লাস টিচার কস্তূরী দি সব বুঝতে পারতেন | পেছন থেকে এসে মাথায় এক গাট্টা মারত | সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতো "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে " | নীলাও বাদ যেত না | তখন সবার সাথে শুরু করতো একই সুর | আজ অ্যার মাথায় গাট্টা দেবার কেউ নেই !! আজ নিজেই প্রাণভরে গাইল |
আজ কিন্তু মনের আনন্দে , প্রাণ খুলে গাইতে গাইতে দুফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল | ছোট্ট বেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নীলার | ছোটবেলার দিনগুলো কে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে নীলা | বলছে ," যেতে নাহি দিব | হায় তবু চলে যায়\ চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে " |
বয়স যত বাড়ছে , শৈশবের সাথে দূরত্ব যত বাড়ছে , ততই যেন মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠছে, স্বপ্ন ভরানো ,ভালোবাসায় ভরানো শৈশবটাকে ধরে রাখবার জন্য | সকলের যেন প্রাণ মন কায় \ এক খানি বাহু হয়ে ধরিবারে চায় , ফেলে আসা ছোটবেলাকে | প্রার্থনা শেষে হেডমিস্ট্রেস একটি ঘোষণা করলেন , "সবাই দু টাকা করে নিয়ে আসবে অবশ্যই "| ছাত্রীরা সবাই সমস্বরে বল্লো, হ্যাঁ বড়দি , নিয়ে আসব |
হেড মিস্ট্রেস নিজের রুমে নিয়ে বসালেন নীলাকে | পরিচয় হল , কুশল বিনিময় হলো | কথাবার্তার মধ্যে অচিরেই সেই প্রসঙ্গ উঠলো , হঠাৎ দু টাকা কেন !! নীলার অবশ্য মনে পরল ওরাও কখনো কখনো 50 পয়সা করে কালেক্ট করত দুঃস্থ কোন ছাত্রীর ইউনিফর্মের খরচা বাবদ | এখনো সেই ট্রাডিশন চলছে | ভালো | সেই যে মেয়েটি ছিল , অঞ্জলি | নীলা ভাল ছাত্রী বলে নাম ছিল | অঞ্জলি তাই নীলার গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকতো | অঞ্জলি হাসপাতালে ভর্তি হল , টাইফয়েড | প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে টাকা তোলা হয়েছিল | কিন্তু নাহ টাকাটা আর কাজে লাগলো না | তার আগেই অঞ্জলি ঘুমিয়ে পড়ল | ঘুম অ্যার ভাঙল না | হাসপাতালে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিল তখনও অঞ্জলীর চোখে বাঁচার স্বপ্ন , মনে আশা | নীলা কে হাত ধরে বলেছিল , তুই কিন্তু আমাকে পড়িয়ে দিস | কত দিন স্কুলে যায়নি | পাস তো করতেই হবে |
কিন্তু অঞ্জলি যে জীবন যুদ্ধেই হেরে গেল !! আনেক দিন পর অঞ্জলির কথা মনে পড়ল |
সেই দু টাকার ব্যাপারে বর্তমান বড়দি কিন্তু অন্যরকম কিছু বললেন | রবি নাম শুনেই নীলার চোখ চকচক করে উঠলো | রবিকে কি ভোলা যায় ! এত বছর হয়ে গেছে ! কি করে ভুলবে ! টানা ছয় বছর নীলা স্কুলে ঢুকতে বেরতে যে সেই লোকটাকে দেখত | কত বছর পর আবার রবির প্রসঙ্গ উঠলো | বড়দি মহামায়া রায় বললেন , রবি এখন তো চলৎক্ষম হীন | কাজকর্ম করতে পারেনা | তুমিও নিশ্চয়ই খেয়েছ ওর ঠেলাগাড়ি থেকে |
_________ হা| কিন্তু বয়স তো অনেক হলো | এখন আর কি কাজ ---!
_________ হ্যাঁ বয়স ত হয়েছে | তবে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রবিকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অক্ষম করে দিয়েছে|
_________ দুর্ঘটনা !!
___________ হ্যাঁ | খুব দুঃখের | ওর ছেলে তোমাদের বড় শহরে মজুরের কাজ করতে গিয়েছিল | কোন এক কনস্ট্রাকশন কম্পানি | নাম টা মনে পরছে না | খুব খুশি হয়েছিল রবি | যাবার আগে ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল | কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না | দশ তলা থেকে ছেলেটা পড়ে যায় !!
___________ তাহলে তো আর !!! নীলা আঁতকে ওঠে
___________ হ্যাঁ |তবে তেমন কোনো কম্পেন্সেশন দেয়নি ওরা | আমার কাছে খবর আসে | আমি কি করে যে নিজেকে সামলেছি !! কদিন আগেই যে ছেলেটাকে আশীর্বাদ করলাম !! রক্তের সম্পর্ক নয় তবু আমার যা অবস্থা গেছে ! রবির কথা আর কি বলব | সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে | একটি জীবনের দাম এত কম ! এরা ধনী অথচ কি নির্দয় | অভাব তো নেই | তবুও গরিব দের দিকে তাকিয়েও দেখে না | সেও নাকি আবার বাঙালি ভদ্রলোক ! এরা কেমনতর হৃদয়হীন মানুষ ! তবে হ্যা , একবার ওদের কাউকে হাতে পেলে অন্তত আমার স্কুলের ছাত্রীরা ছাড়বেনা | রবি ওদের সবার প্রিয় | আচ্ছা এদের কি মানবিকতা বলে কিছুই নেই ! কেবলমাত্র টাকাই আছে ! এদের কি পরিবার-পরিজন, সন্তান, কিছু নেই | রবি বহু পুরনো | তুমিও নিশ্চয়ই ওর দোকানে খেয়েছ !
নীলার মুখে রঙিন প্রজাপতির মত যে হাসিটি উড়ে বেড়াচ্ছিল এতক্ষন , হঠাৎই কেমন যেন মিইয়ে গেল , ফিকে হতে হতে একেবারে উধাও হয়ে গেল | নীলার মেয়ে তখন স্কুলের লাইব্রেরীতে বই নিয়ে ব্যস্ত | নীলার কপালের দুপাশে শিরা দুটো ফুলে উঠলো্ সারা মুখ ঘামে ছপছপ করছে | আবার সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হল | কি যে কষ্ট হয় ! মাগো ! একটু টেনশন হলেই এই ব্যাথাটা চাগিয়ে ওঠে |
দুটি টাকা
"এই রবি আমাকে দে , রবি আমাকে দে , আমি আগে এসেছি , রবি দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু , রবি আমি কিন্তু সব ভেঙ্গে ফেলবো , রবি বেল বাজল বলে , রবি আজ যদি তোর জন্য বকা খাই না দিদিমণির কাছে !! তারপর দেখবি তোর ঠেলা গাড়ির টায়ার পাংচার করে দেব ! "
এতগুলো ছোট ছোট অবুঝ মেয়ের দাপাদাপি রবির মুখের সামনে , তবু রবি অস্থির হয়না , অধৈর্য হয় না | সবাইকে যার যার পছন্দের জিনিস টি দেয় | মাত্র আধ ঘণ্টা চলে এই তুমুল হট্টগল | রবিকে চারিদিক থেকে যেন ভিমরুলের মত ছেঁকে ধরে ! তারপর বেলটা বাজলেই নিমেষে একেবারে খালি হয়ে যায় | রবি তখন বটগাছের তলায় বসে জিরিয়ে নেয় | আবার স্কুল ছুটির সময় কিছু বিক্রি-বাট্টা হবে খন |
" মা সারদা বালিকা বিদ্যালয় " | তারই সামনে এক কোণে রবি ওর ঠেলাগাড়ি নিয়েই বসে থাকে | কি নেই ওরা গাড়িতে ! পাকা তেতুল ! চালতার আচার ! পপিন্স !লেবেঞ্চুস | ডালমুট ! ঝাল মুড়ি ! শোনপাপড়ি ! লেড়ে বিস্কুট ! সবকিছু কাচের বয়ামে সাজানো থাকে | স্কুলের অল্প বয়সী মেয়ে গুলো ওকে ছেঁকে ধরে | কেউ রবির হাত থেকেই পায় , কেউবা ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে চলে যায় কোনও রকমে পয়সাটা দিয়ে | কেউ কেউ আবার চোখ পাকিয়ে বলে , রবি এত ঝাল কেন দিয়েছিস ! রবি হাসি হাসি মুখ করে আবার বানিয়ে দেয় | ওদের দুষ্টুমি রবির চোখ এড়ায় না | বছরের পর বছর এই কাজই করছে রবি | ভালোই লাগে | সংসারটাও চলে যায় |
রবি নজর করেছে , একটি মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে | মনে হয় নতুন | সবার থেকে একটু আলাদা | চেহারায় ধনী ঘরের ছাপ | পরিষ্কার ধবধবে ইউনিফর্ম | মেয়েটি দুই একবার বার চেষ্টা করেছিল ভিড়ের মধ্যে ঢোকার , কিন্তু এমন দাপুটে হাতের কাছে হার মেনেছে | ওর মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব | তেমন সহজ হতে পারে না | রবি বোঝে মেয়েটা সবার থেকে অন্যরকম বৈকি | মোটেই দামাল নয় , দস্যিপনা ওর কম্ম নয় |
রবি নিজেই জিজ্ঞেস করে , দিদি তোমার কি চাই ? নীলা বলে দেয় | রবি ওর কাগজের তিনকোনা ঠোঙায় করে গুছিয়ে রেখে দেয় , তারপর সুযোগ বুঝে, দিদি এই নাও বলে হাতে গুজে দেয় | রবি জানে এই শান্তশিষ্ট মেয়ে টি ওই ডাকাবুকো মেয়েদের সাথে পেরে উঠবে না মোটে |
রবি 50 বছরের মাঝবয়সী | তবে কাঁচাপাকা চুলে বয়সটা অনেক বেশি দেখায় | তবুও ওই কচিকাঁচারা সবাই রবিকে তুই-তোকারি করে | কারো দ্বিধা হয় না | রবির তাতে কোনো আপত্তি নেই, বেশ ভালোই লাগে | ও যেন ওদের বন্ধু হয়ে যায় |
কিন্তু নীলা পারেনা | ওর বাড়ির শিক্ষাদিক্ষা ওকে সবার থেকে একটু অন্যরকম বানিয়েছে | মা বলে , বড়দের তুই-তোকারি করবি না সে যেই হোক না কেন ! মুচি মেথর হলেও না | যে বয়সে বড় তাকে সবসময় সম্মান করে কথা কইবে | নীলা রবিকে , রবিদা বলে ডাকে | রবির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে | মনটা ভরে যায় |
মাঝে মাঝে রবির ছেলে চুপটি করে বসে থাকত রবির পাশে | নীলাকে দেখে কইতো , ওই মাইয়া ডা বড় লোকের বেটি | নীলার বড় লজ্জা করে | নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখত | একদিন অবশ্য রবিকে দেখে নীলা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল | রাগে চোখ লাল , কপালের শিরা ফুলে উঠছে , ছুটে গিয়েছে রবি | এই সা হাত টেনেছে ! হাত একেবারে মটকে দিয়েছিল লোকটর | লোকটা নাকি এমনি এমনি রবির ছেলেকে এক থাপ্পড় মেরেছিল | ব্যাস ! আর যায় কোথায় ! সত্যি সন্তানের জন্য বাবা কি না করতে পারে ! রবি সব ভুলে গিয়ে লোকটার হাত কট করে মটকে দিল | একেবারে রিভেঞ্জ ! রবির সেই রুদ্রমূর্তি এখনো নীলার চোখে স্পষ্ট | বাপরে এত রাগ রবির !! না দেখলে বুঝাই যায়না , ভাবাই যায় না|
,
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আবার সেই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নীলা | স্কুল ছাড়ার পর কলেজ | তারপর বিয়ে | খুব শিগগিরই বিয়ে হয়ে গেছিল | বরের হাত ধরে দূরে , দূরে, অনেক দূরে চলে গিয়েছে | এখানে, সেই ছোটবেলার জায়গায় আর ফিরে আসা হয়নি | দুম করেই বিয়েটা হয়ে গেল | ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগে একবার স্কুলে এসে ঘুরে যাবে কিন্তু তাড়াহুড়োয় সে আর হয়ে ওঠেনি | বড় দিদিমণি অবশ্য ওকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল | লিখেছিলো, " সারা পৃথিবীতে ডানা মেলে উড়ে বেড়াও, খুব সুখী হও | তোমার ঝকঝকে পরিষ্কার স্বচ্ছ মনটা যেন ঠিক একই রকম থাকে | সত্য পথ ছেড়ো না | " আজও সেই চিঠি যত্ন করে বিয়ের অ্যালবামে রেখে দিয়েছে নীলা | পঁচিশ টি বছর পরে , এই ছোট্ট পাড়া গাঁ জন্মভূমিতে এসেছে নীলা | ইচ্ছে ছিল একবার স্কুলটাকে প্রণাম করে যাবে, কারণ স্কুল নীলার কাছে ঠিক যেন মন্দির , তীর্থক্ষেত্র |
মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীলা | ঝাঁ চকচক করছে ওর "সারদা বালিকা বিদ্যালয় " | স্কুল এখন তিনতলা হয়েছে | চারিদিকে সাজান গোছানো গাছের সারি | সামনে পেল্লাই গেট | প্রাচীর | আগে তো এতসব কিছু ছিল না | বোঝাই যাচ্ছে স্কুলের অনেক উন্নতি হয়েছে , স্কুলের জৌলুস বেড়েছে | নীলা খবর পায় , এই স্কুল থেকে নাকি এখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করে !! গর্বে মনটা ভরে যায় নীলার |
মেয়েকে নিয়ে ঢুকলো স্কুলে | সে ---- ই সেদিনের দিনগুলো চোখের সামনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল | প্রথম যেদিন এসেছিল ক্লাস সেভেন এ , সেদিন ছোট্ট একটি গেট দিয়ে ঢুকে ছিল | স্কুলে ঢুকে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল ! কেমন হবে দিদিমণিরা ! ও তো নতুন এসেছে !! ক্লাস এর মেয়েরা কেমন হবে ! আজ কিন্তু মোটেও ভয় নেই নীলার | আজ শুধু আনন্দ আর অদ্ভূত এক শিহরণ |
নীলা অফিস এ জানাতেই , কেউ একজন গিয়ে হেডমিস্ট্রেস কে খবর দিলো | প্রাক্তন ছাত্রী এসেছে শুনে হেডমিস্ট্রেস নিজেই এগিয়ে এলেন | সাদরে নিয়ে গেলেন ভেতরে | ততক্ষণ প্রার্থনার জন্য ছাত্রীরা তৈরি | খুব ভালো সময়ে এসেছে | স্কুলের সেই মাঠ ! সেই চৌকো মাঠ এখনো একই রকম আছে বরং জৌলুস যেন আরও বেড়েছে | চারিদিকে সবুজ | মনে পড়ল ওরা একবার পনরই আগস্ট এ বৃক্ষরোপণ করেছিল | আহা সেই গাছ গুলোই বুঝি বড় হয়ে স্কুল কে একেবারে সবুজে ভরিয়ে দিয়েছে |
স্কুলের প্রত্যেকটি ছাত্রী মাঠে ঠিক সে --ই রকম লাইন করে দাঁড়িয়েছে | প্রার্থনার জন্য সবাই হাত জোড় করে আছে | | সবার সাথে নীলাও দাঁড়িয়ে পড়ল | দুই হাত জোড় করে গাইল , "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে "|
নীলা র মনে পরল সেই সময় নীলার সাথে থাকতো শ্রাবণী , দুর্গা , চুমকি , শুক্লা, গার্গী, মৈত্রী , কেকা | সবাই একসাথে লাইন করে ক্লাস থেকে আসত | ওরা ভারি দুষ্টু ছিল !! কেউ গাইতো না | চোখ মিটমিট করত আর ঠোঁট দুটো একটু নাড়াত | ক্লাস টিচার কস্তূরী দি সব বুঝতে পারতেন | পেছন থেকে এসে মাথায় এক গাট্টা মারত | সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতো "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণও ধুলার পরে " | নীলাও বাদ যেত না | তখন সবার সাথে শুরু করতো একই সুর | আজ অ্যার মাথায় গাট্টা দেবার কেউ নেই !! আজ নিজেই প্রাণভরে গাইল |
আজ কিন্তু মনের আনন্দে , প্রাণ খুলে গাইতে গাইতে দুফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল | ছোট্ট বেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নীলার | ছোটবেলার দিনগুলো কে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে নীলা | বলছে ," যেতে নাহি দিব | হায় তবু চলে যায়\ চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে " |
বয়স যত বাড়ছে , শৈশবের সাথে দূরত্ব যত বাড়ছে , ততই যেন মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠছে, স্বপ্ন ভরানো ,ভালোবাসায় ভরানো শৈশবটাকে ধরে রাখবার জন্য | সকলের যেন প্রাণ মন কায় \ এক খানি বাহু হয়ে ধরিবারে চায় , ফেলে আসা ছোটবেলাকে | প্রার্থনা শেষে হেডমিস্ট্রেস একটি ঘোষণা করলেন , "সবাই দু টাকা করে নিয়ে আসবে অবশ্যই "| ছাত্রীরা সবাই সমস্বরে বল্লো, হ্যাঁ বড়দি , নিয়ে আসব |
হেড মিস্ট্রেস নিজের রুমে নিয়ে বসালেন নীলাকে | পরিচয় হল , কুশল বিনিময় হলো | কথাবার্তার মধ্যে অচিরেই সেই প্রসঙ্গ উঠলো , হঠাৎ দু টাকা কেন !! নীলার অবশ্য মনে পরল ওরাও কখনো কখনো 50 পয়সা করে কালেক্ট করত দুঃস্থ কোন ছাত্রীর ইউনিফর্মের খরচা বাবদ | এখনো সেই ট্রাডিশন চলছে | ভালো | সেই যে মেয়েটি ছিল , অঞ্জলি | নীলা ভাল ছাত্রী বলে নাম ছিল | অঞ্জলি তাই নীলার গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকতো | অঞ্জলি হাসপাতালে ভর্তি হল , টাইফয়েড | প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে টাকা তোলা হয়েছিল | কিন্তু নাহ টাকাটা আর কাজে লাগলো না | তার আগেই অঞ্জলি ঘুমিয়ে পড়ল | ঘুম অ্যার ভাঙল না | হাসপাতালে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিল তখনও অঞ্জলীর চোখে বাঁচার স্বপ্ন , মনে আশা | নীলা কে হাত ধরে বলেছিল , তুই কিন্তু আমাকে পড়িয়ে দিস | কত দিন স্কুলে যায়নি | পাস তো করতেই হবে |
কিন্তু অঞ্জলি যে জীবন যুদ্ধেই হেরে গেল !! আনেক দিন পর অঞ্জলির কথা মনে পড়ল |
সেই দু টাকার ব্যাপারে বর্তমান বড়দি কিন্তু অন্যরকম কিছু বললেন | রবি নাম শুনেই নীলার চোখ চকচক করে উঠলো | রবিকে কি ভোলা যায় ! এত বছর হয়ে গেছে ! কি করে ভুলবে ! টানা ছয় বছর নীলা স্কুলে ঢুকতে বেরতে যে সেই লোকটাকে দেখত | কত বছর পর আবার রবির প্রসঙ্গ উঠলো | বড়দি মহামায়া রায় বললেন , রবি এখন তো চলৎক্ষম হীন | কাজকর্ম করতে পারেনা | তুমিও নিশ্চয়ই খেয়েছ ওর ঠেলাগাড়ি থেকে |
_________ হা| কিন্তু বয়স তো অনেক হলো | এখন আর কি কাজ ---!
_________ হ্যাঁ বয়স ত হয়েছে | তবে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রবিকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অক্ষম করে দিয়েছে|
_________ দুর্ঘটনা !!
___________ হ্যাঁ | খুব দুঃখের | ওর ছেলে তোমাদের বড় শহরে মজুরের কাজ করতে গিয়েছিল | কোন এক কনস্ট্রাকশন কম্পানি | নাম টা মনে পরছে না | খুব খুশি হয়েছিল রবি | যাবার আগে ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল | কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না | দশ তলা থেকে ছেলেটা পড়ে যায় !!
___________ তাহলে তো আর !!! নীলা আঁতকে ওঠে
___________ হ্যাঁ |তবে তেমন কোনো কম্পেন্সেশন দেয়নি ওরা | আমার কাছে খবর আসে | আমি কি করে যে নিজেকে সামলেছি !! কদিন আগেই যে ছেলেটাকে আশীর্বাদ করলাম !! রক্তের সম্পর্ক নয় তবু আমার যা অবস্থা গেছে ! রবির কথা আর কি বলব | সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে | একটি জীবনের দাম এত কম ! এরা ধনী অথচ কি নির্দয় | অভাব তো নেই | তবুও গরিব দের দিকে তাকিয়েও দেখে না | সেও নাকি আবার বাঙালি ভদ্রলোক ! এরা কেমনতর হৃদয়হীন মানুষ ! তবে হ্যা , একবার ওদের কাউকে হাতে পেলে অন্তত আমার স্কুলের ছাত্রীরা ছাড়বেনা | রবি ওদের সবার প্রিয় | আচ্ছা এদের কি মানবিকতা বলে কিছুই নেই ! কেবলমাত্র টাকাই আছে ! এদের কি পরিবার-পরিজন, সন্তান, কিছু নেই | রবি বহু পুরনো | তুমিও নিশ্চয়ই ওর দোকানে খেয়েছ !
নীলার মুখে রঙিন প্রজাপতির মত যে হাসিটি উড়ে বেড়াচ্ছিল এতক্ষন , হঠাৎই কেমন যেন মিইয়ে গেল , ফিকে হতে হতে একেবারে উধাও হয়ে গেল | নীলার মেয়ে তখন স্কুলের লাইব্রেরীতে বই নিয়ে ব্যস্ত | নীলার কপালের দুপাশে শিরা দুটো ফুলে উঠলো্ সারা মুখ ঘামে ছপছপ করছে | আবার সেই মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হল | কি যে কষ্ট হয় ! মাগো ! একটু টেনশন হলেই এই ব্যাথাটা চাগিয়ে ওঠে |
আর দেরী করল না | স্কুল থেকে বেরিয়ে এল মেয়ের হাত ধরে | নাহ , রবিকে একবার দেখেই যাবে | স্কুলের পাশেই এক কোনায় পড়ে আছে ঠেলাগাড়ি , তার ওপর শুয়ে আছে এক জীর্ণশীর্ণ হাড়জিরজিরে বুড়ো | মুখ ভর্তি দাড়ি | নীলা হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রইল | কোথায় চলে গেল মনটা | হারিয়ে গেল সে---- ই দিনগুলোতে | রবির একমুখ হাসি , হাতদুটো মেশিনের মতো চলছে, ঠোঙা বানাচ্ছে, ভরছে , দিচ্ছে | চারিদিকে সবাই চেঁচাচ্ছে রবি আমাকে দে , রবি আমাকে , রবি দে , তোর দোকান ভেঙে ফেলব আমাকে দাড় করিয়ে রেখেছিস , রবি বেল বাজল , আমাকে দিলি না আমি কিন্তু নিজের হাতেই নিয়ে নিলাম , বেশি বেশি নিলাম !
হাতে একটা আলতো ধাক্কা খেলো নীলা | মেয়ের ডাকে হুঁশ ফিরল | মেয়ে ডেকে উঠল , মা মা | নীলা চমকে উঠলো | রবিদা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল , কি চাই দিদিরা !!
বুকের ভেতর কেঁপে উঠল নীলার | চিনতে পেরেছে ? রবি চিনতে পেরেছে ? কিন্তু রবি দাকে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না নীলা কোথায় থাকে , কোথা থেকে এসেছে | ছি ছি ! তবে যে আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না | কি উত্তর দেবে তখন নীলা , যখন রবিদা বলবে তোমাদের শহরে গিয়াই তো আমার ছেলেটা মরল !!
ব্যাগ থেকে একটা হাজার টাকার নোট বের করল নীলা | এগিয়ে দিল | বৃদ্ধ টাকার দিকে তাকিয়ে দেখল , ,মুখে একটা হাসি নিয়ে বলল , " আমাকে কেন টাকা দিচ্ছ না চাইতেই , আমিতো ভিখারি নই গো | তোমরা বড়লোকের বেটিরা স--ব পারো | ভালোবাসতে পারো | তবে টাকার বিনিময়ে ভালবাসাটা বড় সস্তা করে ফেলো | আবার মরণকে নিত্যদিনের তুচ্ছ ছেলেখেলা বলে মনে করো | আমার স্কুলের মেয়েরা দু টাকা করে দিচ্ছে আমাকে | সেটাই অনেক বেশি | কি হবে অত টাকা দিয়ে ! দুইবেলা পেটে দুটো পরলেই হয় | বাঁচার আর ইচ্ছা নাই গো দিদিরা ! তয় উপরওয়ালা না নিলে কি করুম !! তাই দুটা ভাত পেটে পরলেই , আর কিছু চাই না | দুটো টাকা থাকলে , দাও দিদিভাই | "
কিন্তু নীলার কাছে যে দু টাকার কয়েন নেই | বড় বড় নোটে ব্যাগ ভর্তি | রবিদার কথা শুনে নীলার পায়ের তলায় মাটি টা দুলে উঠল | তবে কি রবিদা চিনতে পেরেছে ? আর দেরী করলো না | নীলা মেয়ের হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল | দুই হাতে মেয়েকে চেপে ধরে ঢুকিয়ে দিল | এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল নীলা | মেয়ের মুখের দিকে একবার তাকালো , মাথাটা নিজের বুকে ঠেসে ধরল | বহু বছর আগে রবির রুদ্রমূর্তি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো | কি ভয়ংকর !! ড্রাইভারকে বললো , গাড়ি চালাও জলদি |
নিজের ঝাঁ চক চকে কসমোপলিটান শহরে ফিরে এলো | তৃষিত এর সাথে গল্প হল | সেই ,ছোটবেলা | সেই কৈশোর , যৌবনের এর জায়গা , আত্মীয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব , স্কুল , তোর্সা নদী , রাজবাড়ি --------- অনেক গল্প হল | কিন্তু রবির গল্প হল না |
নীলা জানে রবির গল্প করলে তৃষিত কি বলবে !! তৃষিত চেঁচিয়ে উঠবে , বলবে , ছাড়ো তোমার সমাজসেবা | আমাদের কনস্ট্রাকশনে রোজ কতগুলো করে মরছে | কতজনকে টাকা দেব ? কম্পেন্সেশন দেব ? এরা আসে কেন মরতে !! ওই ছেলেটার , ওটাতো সুইসাইড বলে চালিয়ে দিয়েছি | তাও কিছু টাকা তো দিয়েছি | অত ভাবলে কোম্পানিতে লাল বাতি জ্বলবে | যতসব গেঁয়ো ভূত ! অকর্মের ঢেঁকি' | কাজকর্ম কিছু পারেনা ! পড়ে মরে আর তার দায় কোম্পানির | রাস্তা ঘাটে রোজ কত লোক মরে পড়ে থাকে | কে খোঁজ রাখে !! এ নিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই নীলা |
তারপরই তৃষিত দুই হাতে জড়িয়ে ধরবে নীলাকে , হাসবে , আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে | বলবে, জানো এখন ফ্ল্যাটগুলো দেড় কোটি যাচ্ছে ! হুহু করে দাম বাড়ছে | শোনো , আমাদের বেবিকে আমার কোম্পানির সিইও করব |এখন থেকেই তৈরি করতে হবে বেবি কে |
একা ঘরে নীলা | মেয়ে স্কুল || মনটা মাঝে মাঝেই হু হু করে উঠছে | একটা দু টাকার নোট আতিপাতি করে খুঁজে বেরাল নীলা | কিন্তু পেল না |একটা দু টাকার নোট বা কয়েন আজ বড় দরকার | মাত্র দুই টাকার নোট কিংবা কয়েনে এতো ভালোবাসা এতো সম্মান থাকে !! নীলা জানতো না | সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল | আলমারির ড্রয়ার, সাইড ব্যাগ, মানিব্যাগ, আনাচ কানাচ | কেউ কি দেবে নীলাকে একটি দুই টাকার কয়েন ! নীলা যে আজ মাত্র দুটি টাকার কাঙাল | কেউ যদি দিত নীলা সাগ্রহে অঞ্জলি পেতে নিত | ওর দেবতার পূজায় যে দুটি মাত্র টাকা লাগে | মাত্র দু টাকাতেই সম্পূর্ণ পূজো |