ভূস্বর্গ  ভ্রমণ 

লেখিকা - শ্রীমতী রিমিকা ব্যানার্জি সাধু


ছোটবেলায় ভূগোলে একটা প্রশ্ন আসতো পৃথিবীর কোন জায়গাকে ভূস্বর্গ বলে? উত্তরটা হতো কাশ্মীর। সুদূর কাশ্মীর হলো  স্বর্গরাজ্য। সেই স্বর্গরাজ্যে যাবার সুযোগ হল 2023 সালে মার্চ মাসে। 

একরাশ উত্তেজনা আর উন্মাদনা নিয়ে 25 শে মার্চ শনিবার এয়ার এশিয়ার  ভোর ছটার ফ্লাইটে  চেপে দিল্লির ইন্দিরা  গান্ধী আন্তর্জাতিক  বিমান বন্দর থেকে রওনা দিলাম ভূস্বর্গের উদ্যেশে ।উড়োজাহাজ আকাশ ছোঁয়ার  পরই জানালার বাইরে শুধুই মেঘের রাজ্য। সেই মেঘ রাজ্য ভেদ করে উড়োজাহাজটি যখন নামতে শুরু করল তখন কেউ যেন সামনের রঙ্গমঞ্চের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে নিলো । ছোট্ট খুপরি জানালা দিয়ে দেখা গেল  বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি আর তার পাদদেশে ঘন সবুজ আর হলুদ রঙের গালিচা। সারা শরীরে যেন বিদ্যুত খেলে গেল। সত্যি প্রকৃতি তুমি কতই না সুন্দর।রঙ্গমঞ্চে আরও কি কি চমক আছে তাই ভাবতে ভাবতে কাশ্মীরের বডগাম  ডিস্ট্রিক্টের   শ্রীনগর  আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের মাটি ছুলাম আমরা। 

25th মার্চ 

 ড্রাইভার দাদার  সাথে আগেই যোগাযোগ করা ছিলো । এয়ারপোর্টের ফর্ম্যালীটি মিটিয়ে বাইরে এসে চেপে বসলাম গাড়িতে। বাইরে বেশ ঠান্ডা। গাড়ি এগিয়ে চললো আমাদের প্রথম গন্তব্য  স্থল পহেলগাওঁয়ের দিকে। দূরত্ব 90 km,সময় লাগবে আড়াই ঘণ্টার  মতন। পহেলগাওঁয়ের 60 km মতন আগে অবন্তিপুরা  নামে একটি জায়গা আসলো  ঝিলম নদীর তীরে। জায়গাটি পুরানো মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। ড্রাইভার দাদার কথা অনুযায়ী ঝিলম নদীর বন্যায় পলিমাটির  তলায় চাপা  পড়ে  যায় এবং পরে উদ্ধার করা হয়। এখানে শিব এবং বিষ্ণুর দুটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। আর আছে অসাধারণ প্রত্নতাত্বিক শিল্পকৃতী । আধা ঘণ্টা মতন ঘুরে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের সুসজ্জিত হোটেলটি লিদর নদীর একেবারে পাশে হোটেল হীবনে।  একটি ছোট সেতু পার হয়ে যেতে হবে হোটেলে। সত্যি কথাই তো  যে আমরা ভূস্বর্গে এসে পৌছেছি। লিদর  নদীর কুল কুল শব্দ, নদীর ওপরে বরফে ঘেরা পাহাড়, বিচিত্রময় পাখীসব এবং অনেক অদেখা গাছ.. আরও আছে..... সুসজ্জিত কাঠের ঘর,সুস্বাদু কাওয়া  এবং icing on the cake এর মতন একপ্রস্থ নতুন তুষারপাত। চোখের পাতা যেন পড়তেই চায়  না। কিন্তু ঐ..  আরও  চাই।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম sightseeing এর উদ্যেশে। এখানে আমাদের স্থানীয়  গাড়ি ভাড়া করতে হলো।ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিপাত হয়েই চলেছে। প্রথমে গেলাম  বেতাব  ভ্যালি । বলাই বাহুল্য অপূর্ব সুন্দর। চারিদিকে চীনার ,পাইন এবং বিভিন্ন  গাছ, সারিবদ্ধ পাহাড়, লিদর নদীর অবিরাম স্রোত ,যত্র তত্র বরফ। সময় তুমি থমকে দাড়াও তো , কিন্তু তা কি সম্ভব? তাই আবার চলতে লাগলাম  চন্দনবাড়ির   দিকে। উচ্চতা বেশি হওয়ায় চারিদিকে শুধু বরফ।  বরফের প্রাচীরের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে  চললো আমাদের গাড়ি।চন্দনবাড়ী  তখন সদ্য তুষারপাতে ব্যাতিব্যস্ত। আমারা  পায়ে  গামবুট গলিয়ে চললুম তার আস্বাদ নিতে। একেবারে ধবধবে সাদা বরফ ..  উফফ !!!শুয়ে ,বসে,  বরফের বল  ছুড়ে মেরে মনের আশ মেটলাম। অমরনাথ যাত্রাপথের সিঁড়ির ধাপও দেখলাম, যদিও সবই বরফে ঢেকে আছে। পেট  ভরে  গরম গরম ম্যাগী  নুডলস খেয়ে রওনা  দিলাম  অনন্তনাগ ডিস্ট্রিক্টের   আরু ভ্যালির   উদ্দ্যেশ্যে  ।এটি  একেবারে উল্টো দিকের রাস্তা। ভীষণ ক্লান্ত অবস্থায় পৌঁছলাম আর এক রঙ্গমঞ্চ আরু ভ্যালি।বিস্তীর্ণ তৃণভূমি চারিধারে পাহাড়ে ঢাকা। টুপির মতন সব চূড়াতেই লেগে আছে বরফ। যাত্রা পথের সৌন্দর্য তো এক পৃথক অনুভূতি।এক রাশ খুশি নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। 

পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে গিয়ে বসলাম লিদর   নদীর পাথরের ওপর। নদীটি কলহই  গ্লেসিয়ার সোনমার্গ  থেকে আসছে। পরিষ্কার টলটলে স্রোত। এবার বেরোনোর পালা । আজ যাব শ্রীনগর । পহেলগাওঁ থেকে বৈশেয়ারণ উপত্যকা ( mini Switzerland ) যাবার ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয়ে উঠলো না।তখন যে আফসোস হয় নি তা নয় কিন্তু পরে তা পূরণ হয়ে যায়। চলো এবার চলা যাক শ্রীনগর ।

26 th মার্চ  

পহেলগাওঁ থেকে শ্রীনগর যাবার পথে ভাগ্যলক্ষীর অসীম কৃপায় রাস্তা বন্ধ পেলাম আর তাই আমাদের অনেক ঘুরে ঘুরে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হলো । গ্রামের বাড়ি ঘর , মানুষজন , ক্ষেতখামারের সৌন্দর্য  উপভোগ করলাম আমরা। এটি হলো বাড়তি পাওনা। 

শ্রীনগর যাবার পথে আমরা নুর মহম্মদ  ভাটের দোকান থেকে কেসর, কাওয়া  আরও বিভিন্ন জিনিস কিনলাম। পরে বুঝেছি জিনিসগুলো খুবই ভালো । রাস্তার দুইপাশে সর্ষে ক্ষেতের হলুদ গালিচা, ফুলে ফুলে ছাওয়া নাশপাতি, বাদাম, উইলো ইত্তাদি বিভিন্ন গাছ।বলা বাহুল্য তাদের  পেছনে পাহাড়ের প্রাচীর।  আমাদের ড্রাইভার দাদা  আলাপ করাতে লাগলেন এই বৃক্ষরাজীদের সাথে তাদের দেখতে আসা অথিতিদের মানে আমাদের। আমরা ধন্য। 

শ্রীনগর পৌছে আমরা সরাসরি চলে গেলাম ডাল লেকে। একটি শিকারার সাথে দর দাম করে চড়ে বসলাম তাতে। ক্লান্তি? সেটা কি? প্রতি মুহূর্ত আমাদের কাছে দামী। প্রকৃতির অপরিসীম সৌন্দর্যের ভান্ডার যথাসম্ভব উপভোগ করতে হবে। কিচ্ছুটি ছাড়া চলবে না কো । পড়ন্ত বিকেলে ডাল লেকের কি যে শোভা ! আহ! সূর্যাস্তের লাল আভায় ডাল লেকের রঙ তখন রঙীন ।  চারিধারে শুধু শিকারা । নানারকম সামগ্রী বিক্রি বাটা চলছে। আর কি নেই তাতে? খাবার জিনিস, গয়না, রকমারী সামগ্রী, কাপড় জামা , উপহার , ফুল ইত্যাদি ইত্যাদি।  কত রকম জলজ গাছ, কত রকম পাখি, কত রকম ফুল যে দেখলাম তার তালিকাটি যে শেষ হবার নয়। 

শুধু কি তাই? ভাসমান বাগান, ভাসমান গ্রাম, গ্রামের মানুষজন  তাদের চাষবাস , মাছ ধরা, জীবিকা নির্বাহন এ এক অন্য ইকোসিস্টেম । আমাদের শিকারা  চালকটি লোকাল গান চালিয়ে রেখেছিল আর সবিস্তারে ডাল লেকের বর্ণনা দিচ্ছিল।একটি পদ্মপাতার মালা বানিয়ে উপহার দেয় আমাদের।  এরপর আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম শিকারায় বসে। রঙ্গমঞ্চের অস্তগামী সূর্যের আভায় ডাল লেকের জল ও লালিমাময়  । টলমল জলের তরঙ্গে এক ঝাঁক শালুকের মাঝে সূর্যের  প্রতিচ্ছবি। এক অদ্ভুত অনুভূতি আর ভালো লাগা নিয়ে ফিরে  চললুম হোটেলের দিকে। 

27 th মার্চ 

হোটেলের থেকে হোমস্টে বলাই ভালো। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশ। ঝলমলে রোদ্দুরে লনে বসে গরম গরম ব্রেক ফাস্ট আর  কাওয়া । সাথে টুকটাক গল্প । বাড়িটি আমাদের পুরোমাত্রায়  কাশ্মীরি কালচারের স্বাদ দেয়। দেওয়াল জোড়া সুদৃশ্য গালিচা , ক্রয়েলের   পর্দা , আখরোট কাঠের আসবাব। রাত্রিতে খাবারে  ছিলো  গোস্তবা  ,রুটি ,ফিরনি। আজকে আমরা যাব গন্দরবল   ডিস্ট্রিক্টের  সোনমার্গ (meadow of gold )। ড্রাইভার দাদা রেডি। চড়ে বসলাম গাড়িতে। আজ প্রকৃতি কি চমক রেখেছে আমাদের জন্য? শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ দূরত্ব 80 km এর মতন। সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। স্থানীয় লোকজন , দোকানপাট সব মিলিয়ে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু আমার অবাক লাগলো এটি দেখে যে আমাদের শহুরে সভ্যতার মধ্যেও প্রকৃতি কিন্তু দৃশ্যমান। নাশপাতি, বাদাম, আখরোট , চীনার, উইলো, চেরী, আপেল ,পিচ গাছ যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে । গাছগুলি নানা রঙের  ফুলে ফুলে ছেয়ে রয়েছে। সোনমার্গ পৌছনর আগে z -morh টানেলের  কাজ হওয়ায় রাস্তা বেশ খারাপ। সোনমার্গ পৌছে দেখি অগুনিত গাড়ি, প্রচুর টুরিস্ট । স্নো  স্পোর্টয়ের   জন্য দর কষাকষি চলছে। আবার পায়ে গামবুট গলিয়ে টলমলে পায়ে বরফের ওপর দিয়ে চললাম লাইন দিতে । স্নো বাইক চড়বো  যে। চারিদিকে চীৎকার , নোংরায় বরফ কালো হয়ে গেছে। বরফ গলে পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে পুরো জায়গাটা। তাতে লোকজন আছাড় খাচ্ছে । আমাদের নাম্বারের বাইক এলে সব ভুলে ছুটলুম  তার দিকে। সে তো আরেক অভিজ্ঞতা। এমনিতেই কোনদিন বাইক চড়া  হয়নি তারপর স্নো বাইক। উফফ !!!!!!! এবার আবার সর্ষের ফুল দেখলাম, কিন্তু চোখে। বাইকের ঝাকুনিতে হাড় গোড়  ভেঙে যাবার জোগান তায় চালকটির কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই আরোহির দিকে।তার ওপর প্রচন্ড শব্দ এবং ডিজেলের গন্ধ।  শক্ত হাতে বাইক ধরে রাখাটাও আমাদের দায়িত্ব , পড়ে  গেলেও আমাদের দায়িত্ব।শুধু বাইকটি অক্ষত ওপরে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তার। যাই হোক শেষমেষ পৌঁছলাম পাহাড়ের ওপরে। প্রচুর খাবার দাবারের দোকান। বরফের ওপর দিয়ে অতি সাবধানে চলতে লাগলাম। আরও একটু ওপরে পায় হেটেই উঠলাম।ঘন নীল আকাশের ঠিক নীচেই বরফ।তারও নিচে শুধু বরফ আর বরফ। ডাইনে বরফ,বাঁয়ে বরফ, সামনে বরফ, পেছনে বরফ।   বেশ কিছু দোকান তখনও বরফের নিচে। শুধু চালটা বেরিয়ে আছে। তার ওপর দিব্যি বসা যায় । চারিধারের  বরফের রাজ্য দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলাম কোথাও।গরম কালে বরফ গলে গেলে প্রকাশ পায় সবুজ বৃক্ষরাজি । তখন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে হয়। কিছুক্ষণ পরে  এবার নামবার পালা। আবার লাইন, বাইক, ঝাকুনি, হাড়গোড় , আওয়াজ ইত্যাদি ইত্যাদি। গাড়িতে বসে দেখতে থাকলাম কাদা ভরা নোংরা বরফ, প্রচন্ড শব্দ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং । আমিও তো প্রকৃতিকে পুরোপুরি উপভোগ করলাম কিন্তু দিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা কার্বন ডাই অক্সাইড। আনন্দের মাঝেও কোথাও  একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। 

28 th মার্চ 

গাড়িতে বসে গিয়েছি। ব্যস রওনা দেওয়া বাকি। আজকে আমরা যাচ্ছি  বারামুল্লা ডিস্ট্রিক্টের  গুলমার্গ। এতদিন শ্রীনগরের দক্ষিণে যাচ্ছিলাম আজ যাব উত্তরে। তবে যাওয়ার রাস্তায় আমরা টিউলিপ গার্ডেন ঘুরে যাব।টিকিট কেটে ঢুকলাম, চারিদিকে লাল,গোলাপী, বেগুনি , হলুদ , সাদা  রঙের বাহার।নিজস্বী তুলে , মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে চললাম গুলমার্গের উদ্দ্যেশে। পথে সারিবদ্ধ ক্রিকেট ব্যাটের দোকান। উইলো কাঠ ঘষে হাজারে হাজারে ব্যাট তৈরি হচ্ছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ড্রাইভার দাদা পরিহাসপুরের কথাটি বললেন।শ্রীনগর থেকে প্রায় 20 km দূরে  এটিও একটি পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীন প্রত্নত্বাতিক  ভগ্নাবশেষ। ঝিলাম নদীর ওপরে একটি মালভূমির ওপর তৎকালীন কাশ্মীরের (695-731) রাজধানীটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা লোলিতাদিত্য । 

বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটিয়ে আবার চললাম গুলমার্গের দিকে। 

গতকাল রাত্তিরের মিটবল আর সকালের আলুর পরোটা হজম হয়ে গেছে। চুঁই  চুঁই  করা পেটে একটি খাবার দোকানে রুটি, কাশ্মীরি দম আলু , ডাল তারকা খেলাম। এর পরের চমকটির জন্য কেউ তৈরি ছিলুম না আমরা। 


গুলমার্গে আমরা এক রাত্রি থাকবো তাই একটি হোমস্টে বুকিং করেছিলাম । গুগুল ম্যাপের সহায়তায় আমরা গুলমার্গের বেশ কিছু আগে একটি গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। মনের মধ্যে সন্দেহ আর ভয় দুই হতে লাগলো। যখন হোম স্টেতে পৌছলাম দেখলাম গ্রামের মাঝে    একটা বাড়ি, যেই ঘরে  বাড়ির লোক থাকে সেখানেই থাকবার ব্যবস্তা এবং টয়লেটও কমন। অথচ একটি নামী বুকিং কোম্পানী বুকিং ডট কম  থেকেই আমরা বুক করেছিলাম। আমাদের মন সায় দিলো না আর ড্রাইভার দাদা  বললো গুলমার্গ যেতে। মনটা  দমে গেল। এখনো  পর্যন্ত এত ভালো ঘুরলাম .. যাইহোক গুলমার্গ পৌছেও দেখি লোকে লোকারণ্য। কোন ভালো হোটেল আমরা পেলাম না। মন না মানলেও সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম শ্রীনগর ফিরে যাবার। একটু খানি ঘুরে ফিরে আমরা রওনা দিলাম শ্রীনগরের উদ্যেশ্যে। 

29 th মার্চ 

আজকে আমরা ঠিক করলাম শ্রীনগর ঘুরে দেখবো। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম জামা মসজিদ । যে কথাটি সব থেকে আকর্ষণীয় তা হলো প্যাগোডার কায়দায় মসজিদ। মহিলারও ভেতরে যেতে পারেন। 

মসজিদটি বানানো  শুরু হয় 1394 সুলতান সিকন্দরের আমলে এবং শেষ হয় 1402 মীর মোহাম্মদ হামদানীর সময়ে। পরের গন্তব্য হলো আকবর ফোর্ট বা হরি পর্বত ফোর্ট। আমরা হরি পর্বতে গাড়ি করে উঠে ফোর্টয়ের সামনে থামলাম। পেয়ে হেঁটে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম। এখান থেকে শ্রীনগরের সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ দেখা যায়। এরপর হজরতবল যাবার পালা। ডাল লেকের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি অত্যন্ত পবিত্রস্থান।নবী  মোহাম্মদের মাথার চুল রাখা আছে এখানে ।  

এরপর আরও এক চমক । লাঞ্চের জন্য ড্রাইভার দাদা আমাদের নিয়ে গেল মুঘল দরবারে। এখানে আমরা অর্ডার দিলাম কাশ্মীরি থালি ওজোয়ান। বিশাল বড় একটি থালায় ভাত,পোলাও, রকমারী কাবাব, পনির আর থালাটিকে ঘিরে অনেকগুলি জামবাটিতে নানারকম লোভনীয় পদ। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। পেট পুরে  খেয়ে আমরা গেলাম পরি  মহল দেখতে।দারা সিকহর বানানো পরি মহল ছিলো সেই সময়কার মান মন্দির। সেখান থেকে   

আসিফ খানের বানানো garden of joy নিষাদ বাগে ।  বরফে ঘেরা পির পঞ্জল পাহাড় শ্রেণীর  পাদদেশে অপূর্ব সুন্দর সাজানো বাগান, ঝর্ণা, স্থাপত্য। ফুলে ফুলে  ভরা গাছ। ছোট ছোট ঝোপ তাও ফুলে ভরা। ছোট ছোট ঝর্ণা। এই সব বাগ গুলোই ডাল লেকের চারি দিকে অবস্থিত। তাই সব গুলো থেকেই ডাল লেক দেখা যায়। নিষাদ বাগ থেকে আমরা গেলাম crown of Srinagar শালিমার বাগে। বলাই বাহুল্য  সম্রাট জাহাঙ্গীরের বানানো সেরা প্রমোদ বাগিচা। আমরাও তার রসাচ্ছাদন করে চললুম শপিং করতে। লাল চৌকে কোকি বাজারে মনের মতন কাশ্মীরি কাপড় জামা কেন হলো। শরীর ক্লান্ত। এবার ফেরা যাক আমাদের হোমস্টেতে ।  

30 th মার্চ 

গুলমার্গে না থাকা এবং বৈশেয়ারণ উপত্যকা না দেখার আফসোস যে এই ভাবে মিটবে তা ছিলো ভাবনার বাইরে। গুলমার্গে রাত্রি যাপন না করার জন্য আমাদের হাতে  একটি অতিরিক্ত দিন আছে। ঠিক করলাম দুধ পাতরি যাব। দেড় ঘন্টার রাস্তা। গামলার মতন উজ্জল সবুজ উপত্যকা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে নয় হাজার ফুট ওপরে। ঘাসের গমলটি ঘেরা আছে বরফে ঢাকা পাহাড়ে। তার নিচে সীমাবদ্ধ পাইন গাছের সারি। ইতি উতি পাথর ছড়ানো। মাঝে মাঝে ছোট ছোট জলাশয়। কোনো কোলাহল নেই, ভিড় নেই,  দূষণ নেই। আছে শুধু দুধের মতন সাদা বরফ আর ঝকঝকে পরিষ্কার তৃণভূমি। বেশ কিছু মাত্রায় প্রাণ ভরে অক্সিজেন নিলাম। ঘণ্টা খানেক  কাটিয়ে ফেরার পালা। তিষ্ট ক্ষণকাল বন্ধু বর.. আরও আছে। দুধ পাতরি যাবার রাস্তায় দুই ধরে স্থানীয় লোকেরা সংসার পেতে  বসেছে। মক্কী কি রোটি আর সরষো  কা  সাগ যে খেতেই হবে। আহা ! গরম গরম পরিবেশন  অনেকটা যত্ন আর ভালোবাসার সাথে। পহেলগাওঁ এর মতন অতো ভালো কাওয়া না হলেও উপাদেয়।এই  প্রথম নুন চা আস্বাদন করলাম। শ্রীনগর ফিরে মাল্  পত্তর নিয়ে চল্ লাম ডাল লেকের দিকে। এবার যে হাউস বোটে  থাকার পালা।

বিকেল বেলায় শিকারার জন্য নির্দিষ্ট গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। হেরিটেজ হাউস বোট থেকে একটি সুসজ্জিত শিকারা এসে মাল্ পত্তর সমেত আমাদের নির্দিষ্ট হাউস হোটেলে  নিয়ে  গেল। ঘরগুলি ছোটো কিন্তু মোটামুটি সাজানো। লাগোয়া বাথরুম । ডাইনিং এবং ড্রইং রুম সবার জন্য কমন। কাশ্মিরি আসবাব, বাসন পত্র , পেপার ম্যাশের বাহারি জিনিস। সামনে কাঠের ডেক। সন্ধ্যে বেলার জলযোগ আমরা ডেকে বসেই করলাম। সামনে ভ্রাম্যমান অগণিত শিকারা। অনান্য হাউস বোটগুলিতেও ঝলমলে আলো জ্বলে উঠেছে। দূরে ডাল লেকের পারে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে, ডাল লেকের জলে শালুক ফুটেছে, তারারা  ঝিকিমিকি করছে, মৃদু মন্দ ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে। সামনে শংকরাচার্য পাহাড়ের মাথায় শংকরাচার্য মন্দিরের আলো জ্বলছে। আর আমরা? দেদার আড্ডা জুড়েছি অনান্য টুরিস্টদের সাথে। কাশ্মীরে এত বাঙালি টুরিস্ট দেখবো আশা  করিনি।এখানে দিব্যি বাংলায় কথা বলা যায়। তাই গল্পগুলো ও শুরু হলো বাংলায়।  বিষয়? কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। 

31 st মার্চ 

এখন ভোর সাড়ে চারটে । তৈরি হয়ে শিকারার অপেক্ষায়। ভাসমান সবজি বাজার যাব যে। এবারের রঙ্গ মঞ্চে শুধু রংয়ের মেলা। কতো রকমের যে সবজি বিক্রি হচ্ছে শিকারাগুলিতে । ডাল লেকেই বসবাস করা মানুষজন নিজেরে গ্রাম যা  ডাল লেকেই ভাসমান সেখান থেকে আমদানি রপ্তানির  জন্য এসেছে। অনেক অনেকটা ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এলাম হাউস বোটে। এগুলি আসলে বোট  হোটেল। কারণ হোটেলের মতনই সারিবদ্ধ ঘর এখানে। ব্রেক ফাস্ট সেরে গিয়ে  বসলাম ডেকে। সবাই টুকটাক কেনা কাটা করছে, তথা প্রচলিত দরদাম চলছে। কাশ্মিরী পোশাক পড়ে ছবি তোলাও বাকি রইল না। 

এবার যে ঘরে ফেরার পালা। মাল্ পত্তর গুছিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চড়ে বসলাম শিকারায় । ড্রাইভার দাদা অপেক্ষা করছে গেটে। মাল্ পত্তর গাড়িতে চাপিয়ে রওনা হলাম এয়ার পোর্টের দিকে। রাস্তায় কোথাও লাঞ্চ করবো। একটি রেস্টুরেন্টে নামা  হলো। চেয়ারে বসে খাবার অর্ডার করবো  তখনই ড্রাইভার দাদা টেবিলের ওপর একটি টিফিন কৌটো খুলে রাখলো । ওনার স্ত্রীর নিজের হাতে রান্না করা পদ্ম ফুলের কান্ডের ( নদ্রু )তরকারি। কিছুক্ষণ সবাই বাকরুদ্ধ। এতোটা  পাওনা তো আশাই করিনি। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে চেটে পুটে খাওয়া হলো। ড্রাইভার দাদার বাড়ির জন্য যৎ সামান্য কিছু জিনিস কিনে দেওয়া হলো। বিদায় বেলা খুবই বেদনা দায়ক হয়। আবার আসবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে গেলুম চেকিং কাউন্টারের দিকে। 

এয়ার পোর্টে বসে ভাবতে লাগলাম- প্রকৃতি তুমি কতই না উদার, দুই হাত মেলে আমাদের সবটুকু দিয়েছো । কিন্তু আমরা?  সভ্যতা অসভ্যতার লড়াইয়ে হারিয়ে ফেলছি তোমাকে। 



 শ্রীনগর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজ মাটি ছাড়লো । এবার রঙ্গ মঞ্চের শেষ দৃশ্য। আবার বরফে ঢাকা পাহাড় , সবুজ হলুদ গালিচা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো মেঘের রাজ্যে।