মনীষা কর বাগচী
মনীষা কর বাগচী
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler

বসন্ত
মনীষা কর
বসন্ত নিয়েছে বিদায়। জায়গা খালি থাকে না। কেউ
গেলে অন্য কেউ চলে আসে। বসন্ত যায় গ্রীষ্ম আসে। গ্রীষ্মের তাপদাহে প্রাণ
হাইফাই করে। খরখরে রোদ্দুর। মাঠ ফেটে চৌচির। অনাবৃষ্টি হলে তো আর কথাই নেই।
কিষানের কান্নার শেষ থাকে না। মাথায় হাত সবার। কাঠফাটা রোদ্দুরে একটা
জিনিস বড় শান্তি দেয় সেটা হচ্ছে গাছের ছায়া। ক্লান্ত পথিক মনের আনন্দে
ক্ষণিক বসে যায় বট, অশ্বত্থ, আম, জাম, কাঁঠালের কোলে। কৃষক টোকা মাথায় কাজ
করে চলে সেই রোদেলা দুপুরে।
সূর্য ডুবুডুবু। পশ্চিম
আকাশে সুদূর প্রসারী সোনা রঙের বাহার। সারা খেতে দখিনা সমীরণ বইছে অবিরাম।
ফুরফুরে হাওয়ায় মন ভরে ওঠে। সেই পরিবেশে যে হেঁটেছে জমির আলদিয়ে সে-ই জানে
সে সুখ কত যে মধুর !
তারপর শুরু হবে কালবৈশাখীর উত্তাল
তাণ্ডব। সে কি ভয়ঙ্কর রূপ প্রকৃতির! যে কোনোদিন গ্রামের কালবৈশাখী ঝড়
দেখেনি সে প্রকৃতির রোস বুঝবে না যতই বোঝানো হোক ।
উফফফ...
কি ভয়াবহ পরিস্থিতি। ঘরবাড়ি গাছপালা ভেঙে চুরমার। ছেলেবেলার কথা এখনও মনে
আছে। মানসপটে আজও জ্বলজ্বল করে সেইসব স্মৃতি। টালির ঘর ছিল আমাদের। ঝড় উঠলে
টালি ভেঙে যেত। চারিদিকে গাছপালা ভাঙতো। ভয়ে কেঁপে উঠতো রোমরোম। টেবিলের
তলায় জড়সড় হয়ে বসে ভগবানের নাম নিতাম। বাজ পড়লে রামরাম রামরাম বলতে বলতে
গলা শুকিয়ে যেত। ঠাম্মা সচরাচর খুব একটা ভগবানের নাম নিতেন না কিন্তু ঝড়
উঠলে আর দেখে কে ? হরিবোল হরিবোল হরিবোল কন্টিনিউ বলতেন যতক্ষণ না ঝড় থামে।
যখন অত্যধিক হয়ে যেত, ভয়াবহতা যখন লিমিট ক্রস করে যেত তখন জেঠিমা কাকিমারা
উলুধ্বনি দিত, শঙ্খ বাজাতো । তারপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ঝড়
বিদায় নিত ।
তখন ভেবে কুল পেতাম না ঝড়ের সঙ্গে শঙ্খ
বাজানোর, উলুধ্বনি দেওয়ার কী সম্পর্ক? এখন বুঝি ওটা মানুষের ইচ্ছাশক্তি।
সবাই মিলে একসাথে প্রকৃতিকে অনুরোধ করছে ঝড় বন্ধ করতে আর প্রকৃতিও মানুষের
ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনে ঝড়বৃষ্টি বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। শীলা বৃষ্টিও
বন্ধ হয় এভাবে, আমি দেখেছি।
যাইহোক ঝড়ের পরের দিন সকালে
এক নতুন পৃথিবীর আবির্ভাব হয়। সদ্যস্নাত সুন্দরী বধূর মত সে যেন পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন। চারিদিক একদম শান্ত। শুধু কিছু বেঘর পাখির নয়ন উদাস থাকে।
প্রেম
প্রেম অনেক রকম হয়। কার
জীবনে কখন কি প্রেম আসবে সেটা কারো জানা নেই। ছোট বেলাকার প্রেম আলাদা। বড়
হওয়ার পরের প্রেম ভিন্ন। প্রকৃতি প্রেম, মা বাবার প্রতি প্রেম, ঠাম্মা
দাদুর প্রেম, মামা মাসির প্রতি প্রেম, হাজারো রকম প্রেম থাকে মানুষের
জীবনে। কিছু প্রেম সময় বদলের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়, কিছু
প্রেম ঠিক তেমনি থেকে যায় অম্লান যেমন আগে ছিল।
আকাশ ভরা
তারা ঝলমল করছে। রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে। নির্ঘুম চোখে মিনা চলে গেছে
তার প্রথম প্রেমের কাছে। ছোট্ট মিনা কত প্রেম পেয়েছে সে। সবার ভালবাসা
ভরপুর করে রেখেছে তার ছোট্ট হৃদয়। সবাইকে প্রেম দিয়েছেও সে।
কিন্তু.......
তার প্রথম প্রেম ছিল সোনালী সকাল। পাখির
মধুর গীত শুনে সেই সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠা। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে
এসে নানা রকম পাখির কিচির মিচির শুনতে থাকা। প্রাণ জুড়ানো মন জুড়ানো
স্নিগ্ধ মধুর শীতল হাওয়াতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া। শিশির ভেজা ঘাসে পা
রেখে রেখে ফুল তুলে বেড়ানো। উঠোনে গোবর ছড়া দিয়ে রেখেছে মা। তাজা গোবরের
আর ভিজে মাটির গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত ভাল লাগা সুগন্ধ পাওয়া। গাছের আবডাল
থেকে মায়ের কপালের লাল টিপের মত লাল সূর্যটার ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসা ।
লাঙল নিয়ে কাঁধে টোকা মাথায় চাষি চলে যেত জমির দিকে। শীতের সকালে খেজুরের
রস কত ভাল যে লাগত। মিনা লাল সূর্যটার দিকে খানিকক্ষণ তাকানোর পর একটু চোখ
বন্ধ করে যখন চোখ খুলত তখন দেখতে পেত অসংখ্য লাল নীল হলুদ সবুজ সূর্যের
সমারোহ। আর তখন সে আনন্দে বিভোর হয়ে হেসে লুটোপুটি খেত। হাস গুলো কেমন
প্যাক প্যাক করত, মোরগ গুলো কুকড়ুকু করত সবাই যেন ওকেই স্বাগত জানাত।
মনমাতানো শিউলির ঘ্রাণ, লেবু ফুলের, বেলের ফুলের, আমের মুকুলের সুবাস এখনও
জড়িয়ে আছে মিনার নাকের ডগায়।
এখন সে তার প্রথম প্রেম থেকে অনেক দূরে কিন্তু ভুলতে পারে নি কিছুই সে। ছোট বেলাকার প্রেম কে মনে করে এখনও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিনা।
পাখির কলকাকলী তো দূরের কথা এখন সে একটা কাকের কা কা ও শুনতে পায় না।
নববর্ষ
শীতের শেষে কী নিদারুণ ভাবে ঝরে যায়
পাতা.... ন্যাড়ামাথা গাছগুলো উলঙ্গ ডালপালা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে
থাকে।হিমেলবাতাসে তিরতির কাঁপতে থাকে শূন্য শরীর।নির্নিমেষ চোখে শুধু
অপেক্ষা আর অপেক্ষা বসন্ত রানীর।
সুদীর্ঘ অপেক্ষা শেষে
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে বসন্ত। কিশলয়ে কিশলয়ে ভরে ওঠে উলঙ্গ বৃক্ষরাজি।
আহা ! কী বাহার আকাশে বাতাসে পাহাড়ে জঙ্গলে।এদিক ওদিক থেকে উঁকি মারে নটখট
দুষ্টু মিষ্টি কলিরা। কিছুদিনের মধ্যেই কলিরা ডানা মেলে দেয় নীল আকাশে।
সোহাগী হয় রঙবেরঙের পাপড়ি সাজিয়ে। ভালোবাসায় মেতে ওঠে প্রজাপতি কীটপতঙ্গ
মৌমাছিদের সাথে। নতুন সৃষ্টির নেশায় গা ভাসিয়ে দেয়। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মেতে ওঠে। তাদের আলোয় আলোকিত হয় সমস্ত ভুবন। তাদের সুগন্ধের মাদকতায় নেচে
ওঠে কল্পনাপ্রবণ মানব মন।
এমনি করেই পুরাতন যায় নতুন আসে
ফিরে। নতুন পুরাতনের যাওয়া আসায় সুখে দুখের দোলায় দুলতে থাকি আমরা। নতুন
বছরের নতুন দিনের নতুন সময়ের কিশলয় উঁকি দিচ্ছে আমাদের মনে। মেতে উঠেছি
আমরা নববরণের নবীন নেশায়। ফুলে ফলে পাতায় পাতায় পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণায়
নববর্ষের গীত শোনা যায়। ময়না টিয়া কোকিল ধরেছে সুর। নববর্ষ তোমাকে
সুস্বাগতম গাইছে সুমধুর।
Review Comments
সোসাল মিডিয়া কামেন্টস