কৌশিক সেন
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler
 
                                    মহাপ্রলয়ের পর
আশ্লেষে ভেসে গেছে মেঘ, গর্ভাধানে প্রোথিত আতঙ্ক, অনন্ত চিন্ময়ী নদিটির তীরে তীরে বিষধর সাপেদের বাসায় তুমিও কি উঁকি মেরে আসোনি!
লাবণ্য গেছে, যাক! ক্ষতি নাই। পাহাড়ি পাকদণ্ডির বাঁকে শুকিয়ে যাক বৃষ্টি-স্বেদ। শুধু বলো, এমন নদীর স্পর্শে তুমিও কি ভেলা নিয়ে ভাসোনি!
স্পর্শসুখ, মোহমায়া, মাধবী বিকেলের স্বপ্ন যেন জন্ম জন্মান্তর কারাগারে অভ্যস্ত জীবনের একান্ত সম্বল। জানি। তবু বলো, সূর্যোদয়ের পর পাপড়ির আঙিনায় একবারও হাসোনি!
নির্বীজ কেশরে এই মর্ত্যধাম উপচে উঠবার পরও কতবার গর্ভিণী হয়েছ বলো! কতবার ঋতুবন্ধ হয়েছে এসেছে এই উর্বরা পদ্মরাগে। বলো, একবারও ভালোবাসনি!
তিতিক্ষা
নিজেকে ছিলে ছিলে ছিলাকাটা করেছি প্রতিটি কিনারা। ছেঁড়া মাস্তুল সেলাই করেছি মখমলি চাদরে, রেশমি সুতোয়। নিজেকে নিঃস্ব করবো বলে মানিয়ে নিয়েছি মোহিনী গণিকার আদর। নির্জলা উপবাস পালন করেছি প্রতিটি জ্যোৎস্নাময়ি রাত্তিরে। কৃষ্ণপক্ষের একাদশী এলে বিবস্ত্র নেমে গেছি অন্ধকার দহের গভীরে। মাটির কলস ফেটে গেছে, ছিদ্রপথ দিয়ে বেরিয়ে গেছে তরল অভিমান, উষ্মা। উঠে এসে দেখেছি শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার ছায়া। নশ্বর শরীরকে পাটপাট করে তুলে রেখেছি সুগন্ধি আলমারিতে। দেখেছি, কোথাও থেকে গেছে তার ক্যানাইন দাঁতের দাগ। খুঁটে খুঁটে তুলে দিয়েছি, সবটাই।
স্নানঘরে তখনও কথা বলে বীর্যগন্ধরা। ওদের বলেছি, এখনও সময় আসেনি। চুপচাপ মেনে নিতে হবে আগুনের আগ্রাসন। লেলিহান শিখায় দাঁড়িয়ে যাচাই করে নিয়েছি ঠিক কতটা উত্তাপ সহ্য করতে পারে এই নশ্বরতা। মালতিকুঞ্জের সবকটা ফুল ঝরে গেলে মালা গেঁথেছি শুকনো ফুলের ঝালরে। আজ সবুজ পাতার ওপর রেখে এসেছি শীতল কালাচ। অলৌকিক আলোয় ভরে ওঠা ভোরের স্বপ্নকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখেছি, কোন স্পর্ধায় সে সত্যি হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি তো নিতান্তই এক ঘর পোড়া গরু, সামুদ্রিক লবণের স্বাদ পেতে আমাকে পাড় করতে হবে কয়েক সহস্র মানুষজন্মের পথ!
পাখিসুখ
শরীরে পাখিসুখ নিয়ে জন্ম না নিলে হৃদয়ে প্রবিষ্ট ও নির্গত প্রতিটি ধমনী শুকিয়ে যায়, বাম অলিন্দে বাসা বাঁধে ধূর্ত শৃগালেরা। প্রবাহ মন্থর হলে রক্তকণিকা নীলাভ হয়ে ওঠে। লসিকাগ্রন্থিতে তখন কয়েক শতাব্দীর মন্বন্তর।
বোধের ওপর যে অনন্ত শূন্যতার স্তর, তার পরতে পরতে ঘুণপোকার বিস্তার। নাভিকুন্ডে কোনো সবুজ সঙ্কেত নেই। বিষ পিপীলিকায় ছেয়ে গেছে সুষুম্নাকাণ্ড। নরম পালকে পালকে নিশিযাপনের রেতঃসুখ যদি উপলব্ধি না হয়, তবে এই অন্ধকার থেকে নিস্তার নেই, জেনো।
মধ্যযাম পার হবে এ শরীর। পাখিরা ফিরে যাবে ভাগ্যান্বেষণে। ওদের সাথে সূর্যালোকে ভাসিয়ে দিতে হবে যাকিছু তত্ত্বকথা জানে এ নশ্বরতা। দেখবে, একটা না একটা পাখি ফিরে আসবেই এই শরীরে, সন্ধ্যাবেলায়।
দীর্ঘ কবিতা
প্রতিটি দীর্ঘ কবিতার ভেতর অনেক অনুকবিতা লোকানো থাকে। অন্ধত্বের ওপাড়ে পৌঁছালে দেখা যায় সেইসব সুনিপুণ স্বরলিপি।
প্রতিটি দীর্ঘ কবিতার ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধে ঝুরো কবিতার কপোত কপোতী। ঠোঁটে ঠোঁটে গেঁথে নেয় অজানা স্বপ্নের ঘর গৃহস্থালি…
এক একটি দীর্ঘ কবিতা যেন নিদ্রাহীন দীর্ঘ রাত। কিছু কিছু প্রহরে গভীর রমন আশ্লেষ, কখনও নির্বাক বালিশ ভেজানোর কাল!
প্রতিটি দীর্ঘ কবিতা এক একটি নদীর মতো। তার শরীরের দুই ধারে বাঁধানো ঘাট। কোথাও মঙ্গল আরতি, কোথাও চিতা কাঠ জ্বলে…
প্রতিটি দীর্ঘ কবিতা যেন এক একটি জ্বলন্ত অঙ্গার। ছত্রে ছত্রে অসহনীয় দহন সুখ। কোথাও কোথাও ভস্ম জেগে থাকে বা!
প্রতিটি দীর্ঘ কবিতা এক একটি অনন্ত মহামারীর কাল। কখনও ঘুসঘুসে জ্বর, কখনও বা শ্বাসকষ্ট ওঠে। কোয়ারেন্টাইনে অপমৃত্যু হয় ছান্দসিক বিহ্বলতার!
 
             
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    