পাঠকামি-২৬



পীযুষকান্তি বিশ্বাস




চন্দ্রদহন বইটা হাতে নিয়ে আমার
চন্দ্রগ্রহণ মনে হয়েছিলো , বই খুলে কবিতাগুলো পড়ার সময় সেই ভূমিকা আর গতিপথ
থেকে আমি সরে আসতে পারেনি । বইটা আগাগোড়া পড়লাম, একটা শিল্পকে কতটা যত্নে
লেখা যায় । একটা দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে এগোয়, ক্রমশ ইনটেনসিটি বাড়ে ।





বইঃ চন্দ্রদহন - কবি ঝর্না রহমান



এর
ভাষা, চিত্রকল্প, ছন্দ সমস্তই সুকল্পিত, সুচিন্তিত, সুনির্মিত । একটা
এক্সিলেন্সি বার বার মনে হয় । পাঠের মুহূর্তগুলি নানান কাব্যসত্যের কাছে
এনে দাঁড় করায় । পাঠক আপনা বিম্বে দেখে নিতে থাকেন কবির ভিতরের গভীর
অন্দরমহল ।



এই প্রথম তার কবিতা পড়লাম, এটা আমারই
সীমাবদ্ধতা । বাংলা কবিতার ভুবনে এমন কত তে চন্দ্র নিজেকে দহন করে চলেছে,
তাদের জ্যোৎস্না আমাদের কাছে পৌঁছায় না । আমাদেরও পৌঁছানো হয় না কোথাও ।
আমাকে ভালোবেসে লিখে দিলেন তিনি ঃ কবি  পীযূষ বিশ্বাসকে প্রীতিজনেষু -
ঝর্না রহমান । ৬ অক্টোবর ২০১৮ ।







আমি
মূলত একজন পাঠক, আমি 'কবি' হিসাবে কিছু করে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না ।
তবু সম্মান করে আমাকে তিনি  'কবি' সম্বোধন করেন - আর আমি তার পাঠকামি লিখে
চলি ।





একটা কবিতা পড়ি:





"ভিন গাঙে নয়া নদী ভাসমান ভানুমতী বেদের বহর



শহর হারানো পথ বেসামাল গ্রামীণার চোখের নিমিখ



পরিখার রেখা শেষে ডুব জলে চতুরালি কবির শালিখ



অলীক শস্যের দানা বীজ মন্ত্রে কোলাহল লাল গোলাঘর"





--কবিতা - চন্দ্রদহন ৩







আমি
এতদিন দিল্লিতে যে ভৌগলিক অবস্থানের কথা বলে আসছি,  সাহিত্যের প্রতিটা
ধারায় তার সুঘ্রাণ লেগে আছে । স্থানীয় বিশেষ্য, স্থানীয় উপমা, চিত্রকল্পনা
একটা অজানায় যেন গা ছমছম করে । দিল্লিতে আমি কোনদিন (ধানের) গোলাঘর দেখি
নাই । এই কবিতার যদি কবির হস্তাক্ষর খুঁজি,  যদি খুঁজে নিতে চাই তার শাখা
প্রশাখা - এই এতোটা গ্রীষ্মেও আমি জানি সেই সমস্ত যাত্রাই চলে যাবে শিকড়ের
সন্ধানে । বাংলাদেশে -  আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ।







আর একটা কবিতা পড়ি ।





"জতুগৃহে শয্যাশায়ী অগ্নিসহা মৃতদেহ প্রাচীন নারীর



রমণীয় রাত্রিনীর পোশাকের মগ্নতায় আমার শরীর



ছিন্নভিন্ন প্রতিবার অধস্তন যৌবনের পূর্ণস্তনী চাঁদ



আমার প্রমিত দেহে সনাতন নারীদের বেদেহী আবাদ"



--কবিতা - চন্দ্রদহন ৩





কবিতাটা
পড়ে এক আশ্চর্য অনুভব হয়, কবিকে কবিতার ভিতর মিশে যেতে দেখি । কবি এক নারী
সত্ত্বা, নারীর সমস্ত কামনা নিয়ে সে এক জ্যোৎস্নাকে দাবী করে ।  যা তার
প্রাপ্য আর যা সে প্রাপ্তি, তার ভিতর থাকে অনুল্লিখিত গ্যাপ । রিড বি-টুইন
দ্য লাইন । কবি সেই গ্যাপ জানেন, পুড়ে যাওয়া চাঁদকে এমন অলংকারে বাঁধেন যেন
আত্ম উপলব্ধি দেহের প্রতিটা কোষে কোষে প্রতিফলিত হয় ।



কাব্যরসের
এই উত্তম খেলা নিরন্তর চলতে থাকে সম্পূর্ণ বইটি জুড়ে ।  এর ছন্দের জাদুই
আলাদা । মাত্রা নিয়ে অপূর্ব কাজের নিদর্শন । আট-আট-ছয় ।  একটি পূর্ণ পাঠের
অভিজ্ঞতা মনের মণিকোঠায় তুলে রাখি ।





ধন্যবাদ কবি ঝর্ণা রহমান । আপনি আমায় একটা পাঠের সুযোগ দিলেন । আপনার হাতকে বারবার এমন উত্তম কবিতাগুলো চুম্বন করে উঠুক ।