কবিতা নিয়ে কথাপোকথনঃ




















কবি অগ্নি রায়ের সঙ্গে দেহলিজের সম্পাদক পীযূষকান্তি বিশ্বাস



পীযূষ বিশ্বাসঃ  বাংলা সাহিত্যের এ মুহূর্তে একজন বিশিষ্ট লেখক যিনি দিল্লির থেকে লিখছেন পেশায় সাংবাদিক , নেশায় কবি  -  অগ্নি রায় । প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই দেহলিজের জন্য প্রকাশিতব্য আজকের আলাপচারিতায় ।  অগ্নি দা, একটা কথাঃ নেশা ও পেশা - দুটোই জরুরী । নাকি দুটোকে আপনি আলাদা করেন না ?



অগ্নি রায়ঃ প্রথমেই যেটা বলার, কবিতা একধরণের নেশা তো বটেই, কিন্তু হ্যাংওভারও! সব মেলানো মেশানো এক যাপন। প্রত্যেকদিনের দশটা-পাঁচটা, বাজার-হাট, আড্ডা, পরচর্চা-প্রেম-- সবের মধ্যেই বুনে  থাকা একটা সমান্তরাল যাপন। ফলে যে বা যিনি কবিতা-আক্রান্ত, তাঁর কাছে তো আর অপশন নেই।  জরুরি না হলেও কমলি তো তাঁকে ছাড়ছে না!







পীযূষ বিশ্বাসঃ আর পেশা ? আপনি এতো একজন সাংবাদিক



অগ্নি রায়ঃ  পেশার বিষয়টি তো অবশ্যই জরুরি। মুন্ডু গেলে খাবো টা কি! তবে শুধুমাত্র নিরাপত্তা এলআইসি প্রিমিয়াম বা ইএমআই-র জন্যই নয়, প্রতিদিন একটা সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হলে ধার বাড়ে। মগজের ভারসাম্য তৈরি হয়।

এবারে তৃতীয় প্রসঙ্গ যেটা বলছো। পেশা এবং কবিতাকে আলাদা করি কিনা ?  এককথায় বলতে গেলে আমার পেশার মধ্যে, আগেই যেটা বললাম আর সবকিছুর মতোই কবিতার উপাদান ছড়িযে রয়েছে। আলাদা  সেভাবে করা যায় না হয়তো।   







পীযূষ বিশ্বাসঃ এবছর আপনার এরো একটি কাব্য গ্রন্থ এলো । "জর্দা বসন্ত" । বইটি নিয়ে বাংলা বইমেলায় দারুন সাড়া পড়লো । কবিতার পাঠক অনেকদিন পরে কবি অগ্নি রায় কে পড়তে পারল । সূর্যাস্তের  সঙ্গদোষ থেকে  জর্দা বসন্ত,  এই  বইটা কি অনেক দিন পরে বের হলো না ?



অগ্নি রায়ঃ ছ’ বছর আগে  শেষ বইটি প্রকাশিত হয় ভাষাবন্ধন থেকে। নাম সূর্যাস্তের সঙ্গদোষ। নবারুনদার (ভট্টাচার্য) ব্যক্তিগত উৎসাহেই বইটি হয়েছিল। নিজে হাতে সাজিয়েছিলেন ফাইন্যালি। এ বছর জর্দা বসন্ত প্রকাশিত হওয়ার সময় স্বাভাবিকভাবেই ওনাকে মিস করেছি খুব। ২০০২ দিল্লি চলে আসার পরেও বাংলা লেখালেখির সঙ্গে যোগসূত্রটাই থাকতো না আমার, উনি না থাকলে। আমার প্রবাস জীবনের বাংলা লেখালেখির স্যাটেলাইট ছিলেন নবারুণ দা। ওনাকে নিয়ে দু’তিনটি গদ্যে সে সব বলা আছে। 











পীযূষ বিশ্বাসঃ  সূর্যাস্তের  সঙ্গদোষ থেকে  জর্দা বসন্ত এই ছ বছরে - এতোটা সময় কি নিজেকে নতুন করে চেনার প্রয়াস নাকি অন্য কোন পরিকল্পনা ছিলো ?



অগ্নি রায়ঃ নতুন করে চেনা বলতে, এটা তো একটা জার্নি। কোনও এক অজ্ঞাতের হাত ধরে আযুর পথ কেটে কেটে চলার মতন। বিশ বছর আগের দেখা অবশ্যই আজ বদলে গিয়েছে। নিজেকে প্রকাশের যেটা মেটা ল্যাংগুয়েজ সেটারও বদল এসেছে। নিজের পুরনো লেখা দেখলে বেশিরভাগই বাতিল করে দিতে ইচ্ছা করে আজ।







পীযূষ বিশ্বাসঃ  অগ্নিদা, এই যে ভাষাচরিত্রের কথা আপনি বল্লেন, বাংলা কি কোথাও একটা বদল হচ্ছে ? এখন পশ্চিমবংগ , ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ ছাড়াও সমস্ত পৃথিবীতেই বাংলা ছড়িয়ে পড়েছে, এটা কি সাহিত্য চরিত্র বদলে দিচ্ছে ?



অগ্নি রায়ঃ দ্যাখো পীযূষ, শুধু বাংলা বলে তো নয়, স্থান, কাল, পাত্রের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব ভাষাই বদলাতে থাকে। বিভিন্ন সময়, বদলে যাওয়া রাজনীতি, সমাজনীতি এবং ভূখন্ডের চিহ্ন তার শরীরে প্রোথিত হতে থাকে। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র এবং ধরা যাক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় – এই দুজনের ভাষাগত কাজ পাশাপাশি রাখলে দুটি পৃথক সময়, রাজনীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মায় যৌনতার ফারাকও কি দেখতে পাই না ? দুটি পৃথক কালখন্ড বলেই যে এই বদল তা বলছি না। বলছি, দুটি পৃথক কালখন্ড বলেও এই বদল! আমি আমার শৈশবে যে বাংলা ভাষা আমার বাড়িতে শুনতাম তার মধ্যে বিশ শতকের গোড়ার দিককার উত্তর কলকাতার গন্ধ লেগে থাকতো। আবার মামাবাড়ির দিকে শুনতাম তুবড়ির মত ছুটছে খাস সিলেটি-র কিছুটা রিফাইনড সংস্করণ। ফলে এই দুইয়ের ককটেল-বাংলায় আমার প্রথম শ্রাব্য ভাষা তৈরি হয়। আর আজ তার চল্লিশ বছর পর আমার ছেলে যে বাংলাটা শুনছে (যে দিল্লিতেই বড় হয়েছে) তার মধ্যে মিলে মিশে যাচ্ছে হিন্দি, ইংরেজি, কিছু হরিয়ানভি শব্দও। এক ভাষা শংকর তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইছো ভাষা সাহিত্যের কথা। সেক্ষেত্রেও আমার জবাবটা মোটের উপর একই থাকবে। তবে আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া উচিত, শুধুমাত্র ভাষা তো আর একক ভাবে সাহিত্য চরিত্র বদলাতে পারে না।







পীযূষ বিশ্বাসঃ  তাহলে বলতে হয় যে ভাষা ও কন্টেণ্ট আলাদা বিষয় । ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলেন ।



অগ্নি রায়ঃ  ভাষাকে যদি সাহিত্যের গভীর ত্বক হিসাবে দেখি, তাহলেও নয়। তার তো গতরও রয়েছে! অস্থি, মজ্জা, স্নায়ু, রক্ত অর্থাত গোদাভাবে যাকে কন্টেন্ট বলি, তারও বদল ঘটা প্রযোজন এবং তা ঘটছেও। পেশার কারণে এই যে দেশের এত গ্রামে ঘুরেছি উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতের গ্রামে, কোথাও কিন্তু পথের পাঁচালি-র টেক্সটকে খুঁজে পাইনি। সাংবাদিকতার কারণে বা বাঙালি পাঠকের সঙ্গে কানেক্ট করার জন্য অপু দুর্গার আর্কেটাইপ কোনও গ্রামের সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য লিখতে গিয়ে কখনও কখনও ব্যবহার করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্ত যদি নিখাদ সাহিত্য প্রসঙ্গ বলো, না, অপুর রেলগাড়ি দেখার বিস্ময় নিয়ে কোনও লিনিয়ার ন্যারেটিভ এখন আর লেখা বা ভাবা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ, ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গ-- সবটা মিলিয়েই এটা আমার মনে হয়।







পীযূষ বিশ্বাসঃ ভাষাচরিত্র যে বদল নিয়ে আপনি বলছেন, সেটা কি কবিতা ভিত্তিক নাকি কবিতা, নাটক, উপন্যাস সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ?



অগ্নি রায়ঃ  নাটক বা উপন্যাসে তো আমি বলবো আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ যে সময়ে বসে লেখা হচ্ছে তার কনটেক্সটচুয়ালিটির একটা দায় সমসময়ভিত্তিক উপন্যাসটিতে থাকে (অবশ্যই সবক্ষেত্রে নয়)। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে গ্রীক নাটক বা চৈতন্যের সময়কার বাংলা নিয়ে কোনও পিরিয়ড নাটকের ক্ষেত্রে কোন ভাষা বা সংলাপ ব্যবহার করা হবে তা অবশ্যই নাট্যকারের বা ওপন্যাসিকের চয়েস এবং নিরীক্ষার জায়গা। তাঁর সামনের ভাষা আলমারিতে রয়েছে অসংখ্য লকার। তিনি তাঁর মত করে তার থেকে প্রয়োজনীয় ভাষাটি কলমে নামিয়ে নেবেন। কী বলতে চাইছি এবং কেন বলতে চাইছি, তা যদি স্পষ্ট থাকে তাহলে সেই মাপে তৈরি হয়ে যায় কীভাবে বলতে চাই ।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  কোন উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে ?



অগ্নি রায়ঃ এই ইচ্ছা আমার প্রবল। তবে এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তুমি যদি কোনও প্রকাশনা করো তাহলে হতেও পারে (হাসি)।







পীযূষ বিশ্বাসঃ  নানান সাহিত্য আসরে শুনি , সঠিক কন্টেন্ট উঠে আসছে না । শুধু ফর্ম নিয়ে লেখক ও কবিকূল মজে আছেন । অথচ উপন্যাসও একসময়  কবিতার আকারে লেখা হয়েছে কিংবা উপন্যাস নিজেই আবিষ্কৃত হয়নি । কবি হিসাবে কবিতা লিখতে লিখতে আপনার মনে হয়েছে উপন্যাস একটি আলাদা বস্তু ?



অগ্নি রায়ঃ আসলে কবিতা এবং উপন্যাস এই দুই রচনার মন এবং মেজাজাটাই আলাদা। উপন্যাসে প্রত্যেকটি চরিত্রকে তার স্থানাঙ্ক থেকে দেখা এবং দেখানো জন্য এক ভিন্নধরণের কৃতকৌশলের প্রয়োজন হয়। ঔপন্যাসিক এখানে ঈশ্বর। যিনি নিজে বহু খন্ডিত হন। চার, পাঁচ বা দশেরও বেশি চরিত্রের মধ্যে সেঁদিয়ে গিয়ে তাদের জল, বাতাস তামাক ও অন্ন দেন। এক একজনকে এক একরকম অনুপানে। কবিতা লেখার জন্য, তুমি ভালই জানো, অন্য ধরণের মন মনন লাগে। সেই মন উপরোক্ত পথের পর্যটক নয়। তার তুমুল অনিশ্চয়তা, আলো ও অন্ধকার তার একান্ত নিজেরই। অন্য কোনও দ্বিতীয় পক্ষের সে ধার ধারে না। আত্মধ্বংসের (বলা বাহুল্য শারীরিক নয়) পথে হাঁটতে হাঁটতে সে আবিষ্কার করে এক অলীক ও অনন্য নগরী। একবারেই সবটা খুঁজে পায় এমনটাও নয়। তবে কাজটা বাইরে থেকে সেই সিসিফাসের মতনই। সেই মন আবিষ্কার করতে করতে এগোয় এক মায়াসভ্যতা যা প্রাত্যহিকতার পলিতে চাপা পড়ে রয়েছে।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  জনশ্রুতিতে শোনা যায়,  তুলনামূলক ভাবে বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতি ভারতের অন্যান্য ভাষার থেকে এগিয়ে । আপনিও তো ভারতের নানান ভাষার কবিতার সঙ্গে পরিচিত । বিদেশী কোন কোন সাম্প্রতিক লেখক আপনাকে প্রভাবিত করে ? এবং অবশ্যই ভারতের অন্য ভাষার কোন কোন লেখক ?



অগ্নি রায়ঃ  বিদেশি কোন সাম্প্রতিক লেখক প্রভাবিত করে এবং ভারতের অন্যভাষার লেখক প্রশ্নটিকে নিজগুণে যদি একটু বদলে নিই তাহলে আমার উত্তর দিতে সুবিধা হয়। বলতে চাইছি সম্প্রতি কোন লেখা আমি পড়ি তা নিয়ে। নন ফিকশন এখন অনেক বেশি পড়ি। কূটনৈতিক বিশ্ব, রাষ্ট্র এবং সমাজনীতি, সোশিও সাইকলোজির যে বিস্তীর্ণ পরিসর ক্রমশ গড়ে উঠছে বিশ্ব জুড়ে, তা আমায় হন্ট করছে বেশি। বিশ্বের চেনাজানা যে সব সূচক ছিল, দৃশ্যকল্প ছিল তা বদলে গিয়েছে দ্রুত। এই বদলের ইতিহাসকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখার একটা তাগিদ রয়েছে। ইনফো-উইজডমের দিকটিও হেলাফেলার নয় আর। এর বাইরে যা পড়ে রয়েছে তা আবহমানের বাংলা কবিতা, যার কাছে নেহাত জলপানের কারণে ফিরে যেতেই হয়।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  দিল্লি ও তো ভিনপ্রদেশের ভিতর পড়ে । বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন । এতবছর প্রবাসে একজন বাঙালি কবির জীবনযাপন কেমন হয় ? কোন নতুন কবি বা লেখকে ফলো করছেন ?



অগ্নি রায়ঃ নতুন কবিদের লেখা পড়া এখন আর দিল্লিতে বসেও কঠিন কোনও কাজ নয়। গত কয়েকমাসে বেশ কিছু অল্পবয়সী কবির বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, বিস্তারিত লিখেছিও তা নিয়ে। এছাড়া নজর রাখার চেষ্টা করি জাপান ও কোরিয়ান বেল্টের কাজের দিকে।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  বিদেশী কোন কোন সাম্প্রতিক লেখক আপনাকে প্রভাবিত করে ? এবং অবশ্যই ভারতের অন্য ভাষার কোন কোন লেখক ?



অগ্নি রায়ঃ পড়ি, ফলো করার চেষ্টা করি, মুগ্ধ হই । শুধু ফিকশন নয়, তাদের সিনেমা, গ্রাফিক নভেল, ইনস্টলেশন আর্ট, এমনকি থ্রিলারও। উপন্যাস একসময় মুরাকামি থেকে শুরু করেছিলাম। অনেক পরে কেইগো হিগাশিনোর একের পর এক কাজ পড়ে ছিটকে গিয়েছি বলা যায়। বিশ পঁচিশ বছর আগে যেভাবে গোগ্রাসে গিনসবার্গের কবিতা বা মার্কেজের উপন্যাস পড়া হত।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  তুলনামূল্বিক ভাবে শোনা যায় ভারতীয় অন্যান্য ভাষার থেকে বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে ?  খুব হাই লেভেলে বলতে গেলে বাংলা ভাষার আগামী ও ভবিষ্যত নিয়ে দুটো কথা যদি বলেন ।



অগ্নি রায়ঃ দ্যাখো, যে কোনও ভাষা বেঁচে থাকে শুধুমাত্র তার প্রসাদগুনে তো নয়, তার পিছনে একটা সমাজ অর্থনীতির সমীকরণও থাকে। সেই ১৯১৩ সালের পর কোনও বাংলাভাষী কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন না – এই ক্লিশে যদি বাদও দিই। হিন্দু বা মালয়লির চর্চা এবং প্রসার নিয়ে যে স্কেলে হৈচৈ হয়, তার অর্ধেকও বাংলা নিয়ে হয় কি বছরভর? বাংলাদেশকে আমি এই হিসাবের বাইরেই রাখছি।





পীযূষ বিশ্বাসঃ  ধন্যবাদ কবি অগ্নি রায় । আপনার আগামীর সাহিত্যকর্ম পাঠ করার জন্য মুখিয়ে থাকবো । আশা করি আমাদের পত্রিকা দেহলিজের সঙ্গে থাকবেন । আরো কিছু প্রোজেক্ট নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি ।



অগ্নি রায়ঃ ধন্যবাদ কবি ও সম্পাদক পীযূষকান্তি বিশ্বাস । নিশ্চয় আগামীতে আমরা আরো কাজ করবো ।   শুভেচ্ছা ।