আকষ্মিক লড়াইয়ের এই আখাড়ায়



দিলীপ ফৌজদার





মনখারাপ করা বিকেলকে যদি চিনে দাঁড় করাই, তার প্রোফাইলকে বাডাতে বাডাতে কোথায় বা কোনখানে গিয়ে পৌঁছাই? একা নিজের কাছে থাকলে সর্বত্রগামী দ্রুতগতি মন তার নিজের খেয়ালে যে কোনখানে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একা থাকতে দেয় না শরীর ও তার ব্যথাবেদনা। মানসিক হোক, শারীরিক হোক নিজের কাছেনিজের একটা বোঝাপড়া এখানে। না, তৃতীয় কোন শরিক সেখানে নেই। একদিকে আমি, অন্যদিকেও আমি। একটা লড়াইয়ের মতই দাঁডিযে যাই মুখোমুখি। যেন আকস্মিক একটা লড়াইয়ের আখাড়ায় কেউ এনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। মুখের কাছে মস্ত একটা জানালা, কাচের ওপর চেটান পারদর্শী ধুসরকালো ঝিল্লির ওপারে রোদের রং দেখা যায় না। এইখানেই আমার জগৎ আর রোদবাতাসের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্কেরো ইতি। একটা বিচ্ছিন্নতার বেদনা  ঘিরে থাকে এই বোধের সাথে সাথেই। বাইরে ঘনসম্বদ্ধ গাছেদের একটা জটলা। এক মূহুর্ত মনে হয় কোন অজানা অচেনা জঙ্গলে শুয়ে আছি একা একটা ক্যাপসুলে। জানালার সিনেমাস্কোপের জঙ্গলে যখন তখন আসে যায় নানান পাখিরা। পায়রা, শালিখ, বুলবুলিরা তো আছেই। কখনো আসে কালো, উজ্জ্বল চোখের, বড়োসড়ো একটা ময়না। একা একা সে গান গায় - তার নরম সুন্দর গলার আওয়াজের অল্পই ঐ চোখঢাকা টিন্ট কাচের বাধা টপকে আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছায়। একটা নাদুসনুদুস প্যাঁচা এসে চুপচাপ বসে থাকে - এতো কাছে যে কাচের বাধা ভুলে ভাবি যে ছুঁয়ে ফেলব। ঐ টিন্ট কাচের বিশাল জানালার অবরোধ যেন আমার এই সমযকার অবস্থার সঙ্গেই মানিয়ে গেছে। এই দৃষ্টির কুহক, কিছু দেখা কিছু দেখার অতীত, কিছু শোনা কিছু শুনতে না পাওয়ার উদ্ভটতত্ত্ব আমার ব্যথাযন্ত্রনার বিকল্প হয়ে অদ্ভুত, অলৌকিক এক সময় কাটানোর খেলায় আমাকে নিয়ে আসে।







আমার কুঠুরির ভেতরে যখন কিছু নীরব আনাগোনা শুরু হয় ধবধবে সাদা পোষাকে তখন আবার ব্যথাবেদনারা ফিরে আসে দলবেঁধে। আমাকে ওরা এই যান্ত্রিক বিছানার স্যুইচ টিপে তুলে বসায়। অ্যালুমিনিযামের ফয়েল ছিঁড়ে হলুদ লাল কি সব খাওয়ায় তখনই আবার এটাও দেখি যে ঐ জানালার সিনেমাস্কোপের ঘনসম্বদ্ধ বনস্পতিরা সরে দাঁডিযেছে আর রোদের এলাকা বেড়ে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা ঘাসজমির মাঠ। তাতে 'জগৎ পারাবারের তীরে শিশুরা করে খেলা' - যেন জানালাটাকে আর একটু বাঁয়ে ঠেলে দিলেই দেখব অপার সমুদ্রের ঢেউ আছড়াচ্ছে এই শিশুদেরই খেলার সৈকতে।এরকম ছিমছাম সুন্দর একটা কুঠুরিতে যন্ত্রময় এই বিছানায শুয়ে শুযে একটা ক্ষতবিক্ষত শরীরের দায়কে নিযে, সময়কে নিয়ে, যে কালাতিপাত সেটাও নেহাতই একটা ভোগ আর পাঁচটা ভোগের মতই। আর ছিমছাম পরিচ্ছন্ন এই ঘরের যন্ত্রময়তা তার একান্তই নিজস্ব স্বাভাবিকতায় আমার এই সময়কার যন্ত্রণাময়তার সঙ্গে ঘর পেতেছে। এই শরীরেরই কেজানে কোন অজ্ঞাত জায়গার থেকে বেরিয়ে আসা অজস্র টিউব যন্ত্রমতেই বুঝিয়ে দিচ্ছে শরীর নামক এই যন্ত্রে কোন রহস্যময়তা নেই। সতত  চলমান এই যন্ত্রে ইন্ধন লাগে, নিকাশী লাগে। শরীরের যে জরুরি ব্যবস্থাগুলি প্রকৃতিদত্ত সেগুলি বন্ধ করে রাখতে হলে তার বিকল্প বন্দোবস্তগুলিকেও খাড়া করতে হয। সেগুলো থাকলেই শরীরটাও আছে।




এই বিকেলটা চেনা চেনা। মনখারাপটাও। খুব সহজেই এর একটা নাম দিয়ে ফেলা যায়। খুব উপযুক্ত না হলেও এর সর্বিক নাম একাকীত্ব।





এমনি একাকীত্বের সঙ্গে আরো অনেক রকম অবস্থায় মুখোমুখি হতে হয়। কোনটায় অবাক হওয়া আবিস্কার, কোনটায় পুরোণ লুকিয়ে থাকা দুঃখ আনন্দের সমাহারে গড়ে নেওয়া অপরূপ এক উপাখ্যান।  একটা ছবি ফুটতে ফুটতে আরেকটাকে আমন্ত্রণ জানায়। অনেক পুরনো ভালবাসার মুখ । মনে হয় সবাই যেন আছে। ভালবাসায় ভালবাসায় ঢেকে যায় তীব্র ঈথরের গন্ধ। তার সঙ্গে ঢেকে যায় কে আছে কে নেই জানার বাসনা। উৎসবের ইশারাগুলি কাছে এগোতে চায় তার আগেই বিকৃত শব্দধোঁযার আগুনবাজী অন্য কোন অবস্থায় সঙ্কটের আবর্তে পড়ে ।  তখন ভয়ের জায়গাটায় এসে বসে মুখোমুখি রাক্ষস।  এই রাক্ষসদের একটা তো ব্যথাযন্ত্রনা যেটা লড়াইকে ডেকে আনে। শারীরিক। অন্যগুলো আনে হতাশা,  উৎকণ্ঠা,  থামগুলোয় আজন্মকালের নির্ভরতায় একে একে ধ্বস নামার অসহায়ত্ব, বিচ্ছেদ।







ব্যথাযন্ত্রনার রাক্ষসদের মোকাবেলা করতে কখনো অন্য কোথাও বেড়াতে চলে যাই। মৌমাছিদের বাসা থেকে মধু চুরি করি, খাই।  আকাশে আলো জ্বালায় তারারা, জোনাকিরা। তারারা তো ওখানেরই, ওটাই ওদের বাড়ি। জোনাকিরা ওঠে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অন্ধকার আকাশে দেওয়ালীর প্রদীপ জ্বালতে। সে প্রদীপ বাস্তবের আলোর চাইতেও অনেক স্নিগ্ধ, অনেক নরম।







ঘুম আর জাগরণের মাঝে মাঝে এমনিতর অনেক কোটর যারা কখনো কখনো জেগে উঠে আমাকেও জাগিয়ে দ্যায়। এই খুপরি খুপরি আলো-অন্ধকারের কোথাও জীবন, কোথাও বেঁচে থাকার আস্থাবোধ, কোথাও কোথাও মৃত্যুর। শুন্য জায়গাগুলো থাকে অন্যত্র কোথাও। বিচ্ছেদ সেখানে একটা বড়সড় গব্হর অধিকার করে থাকে। এগুলোর কোনটাই বিষাদ নয়। সেখানে  নিজেকে জুড়ে না রাখলে সমস্যা একটা আছেই।  এই সমস্যার থলকুল পাই না। আবার কোন রহস্যের অলিগলি ধরে আপনাআপনিই বেরিয়েও আসি। এই আলো-অন্ধকারের অন্তরীক্ষে সর্বক্ষণের থাকা একান্তই নিজের কাছে, সেখানেও অবাক হবার অনেককিছু। একটা গভীর আস্থার রক্ষাকবচ ঘিরে রাখে। কাছ ঘেঁসতে দেয় না নৈরাশ্যকে, হতাশাকে, এমন কি বিষাদ, ভাঙা মনস্থিতির ফাঁকা যে জাযগা জন্ম নিযে বেড়ে উঠার চেষ্টায থাকে তারাও তফাতে থাকে। সবচাইতে যে কথাটা আমাকে কখনোই ছেড়ে যায় না সেটা হোল এই যে এই বিচ্ছিন্নতায়, নিরিবিলিতে, দৌড়হীন, ভাবনাহীন, যেন বেশ আছি।