গলিত রজন ও পরমকণা প্রসবের কথা



জপমালা ঘোষরায়ের পূর্বপ্রকাশিত দুটি নিঃশেষিত কাব্যগ্রন্থ "শিশিরের নেটওয়ার্ক" এবং "দেয়াল ও অ্যাপ্রন"-এর যুগ্ম সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন কালকথার পক্ষে মৌলিনাথ বিশ্বাস। বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় জপমালা ঘোষরায়ের কবিতাকে আশ্রয় করে এক আদি মাতৃকা তাঁর নিজস্ব অন্তর্গূঢ় জীবন লিখে রাখছেন -- একটু অন্তরালে থেকে, একটু সংকেতে, আভাসে। তাঁর অস্তিত্বে, তাঁর চেতনায় মিশে আছে জন্মের মুহুর্তের আলোকোদ্ভাস ও এক ক্রমাগ্রসর - যা জীবন ছুঁয়ে থাকে। জন্মদানের উচ্ছ্বসিত আনন্দটুকুই তাঁকে চালিয়ে নিয়ে যায় - প্রাথমিক এবং প্রধানভাবে। জপমালার কবিতা জন্মের কবিতা। বহমান জীবনের কবিতা।  এবং তাঁর নিজস্ব চোখে জীবন দেখার কবিতা। তাঁর এই দেখাগুলো এখন পাঠকের সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে।





                            ভুলোধরা আচারের শিশির মতো


                     জানলার রোদ্দুরে রেখে দেওয়া মেয়েটি


                     বাই-সাইকেলের মতো পুরোনো ছেলেটিকে


                            নির্জন দুপুরে ডেকে বললো


                      মানুষ একলা আসে, একলা যায়, একলা কাঁদতে পারে না,


                              এসো, ঝামরে পড়ে কাঁদি, নির্জনতা ভাঙি     (সম্পর্কিত প্রেমকথাগুলি)





ছয় লাইনের কবিতা।  বাতাসের আসা যাওয়ার মতো সহজ ভাবে এসেছে শব্দগুলো।  কাটা কাটা লাইন জোর করে জুড়ে, এবং মাঝে মাঝে স্পেস এনে যেভাবে "কবিতার মতো" কবিতা লেখেন কেউ, জপমালার কবিতা তার বিপরীত মেরুতে বলেই তাঁর কবিতার প্রতি আমার পক্ষপাত। এই কবিতাটিতে একটি নির্জন দুপুর, "আচারের শিশির মতো জানলার রোদ্দুরে রেখে দেওয়া" একটি মেয়ে, "বাই-সাইকেলের মতো পুরোনো" একটি ছেলে অগ্নি সাক্ষী করে পাঠককে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি "ভুলোধরা আচারের শিশির মতো জানলার রোদ্দুরে রেখে দেওয়া মেয়েটি"র উপমায়। কী করে কেউ ভাবতে পারেন এমন একটি উপমা ! লক্ষ্যনীয় -- মেয়েটি নিজে আসেনি, সে স্বয়মাগতা নয়।  তাকে "রেখে দেওয়া" হয়েছে।  একটি কিংবদন্তির মতো লাইনে মেয়েটির, বা, সাধারণভাবে, সমস্ত মেয়ের সামাজিক অবস্থান ধরে রাখা হলো। জানলার রোদ্দুর পর্যন্ত তার সীমানা, তার স্বাধীনতা। তার উপযোগিতা, তার ব্যবহার যোগ্যতা নষ্ট না হবার জন্য এটুকুই তার প্রাপ্য শুধু। এটা বলে রাখা জরুরী যে এরকম কোনো উপমা আমার যৎসামান্য পাঠাভ্যাসে আমি আর কখনো পাইনি। আমি জানি এই উপমাটি অপ্রতিহত ভাবে সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল আমার। এবং, সেই সঙ্গে, সম্পূর্ণ এই কবিতাটিও। এতোটাই চমকপ্রদ, অস্তিত্বের এতো গভীরে ছড়িয়ে যায় এই অদ্ভুত দেখাটি, যে, "বাই-সাইকেলের মতো পুরোনো ছেলেটি" তার সমূহ উজ্জ্বলতা নিয়েও একটু আড়ালে একটু অন্তরালে চলে যায়। "ভুলোধরা আচারের শিশি" আর "বাই-সাইকেলের" মধ্যে যেন এক পুরনো পৃথিবীর গল্প লেখা। এক অর্দ্ধ-স্ফূট সম্পর্কের কথা লেখা।  মেয়েটিই এগিয়ে আসছে একটি পরিণতি দিতে এই সম্পর্কটিকে, যখন সে বলছে - "মানুষ একলা আসে, একলা যায়, একলা কাঁদতে পারে না,/ এসো ঝামরে পড়ে কাঁদি, নির্জনতা ভাঙি।" এমন নির্মোহ, এমন সহজ, এমন অমোঘ একটি অনুভূতির (মানুষ একলা আসে..... ইত্যাদি) কাছে আমার একজীবনের ঋণ থাকবে - এবং কবিতাটিকে, আমি অসহায়ভাবে জেনে রাখলাম, আমাকে বহন করতে চলতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত। যেমন বহন করতে হবে --        


 

          --ওই দেখ এসরাজ !

          --আকাশে এসরাজ কি গো !

          --তাহলে ওগুলো তোর দাদুর আঙুল !



          আঙুল বাজছে

          বাজতে বাজতে পরিয়ে দিচ্ছে

          কালপুরুষের খুলে যাওয়া বেল্ট

          গলিত রজনের মতো ঝরে পড়া বাবার গ্রন্থিস্রোত

          মিশে যাচ্ছে মায়ের নীলাভ গর্ভজলে

          আমার দরবারী জন্মে ...                      (আমার দরবারী জন্ম)



এভাবেই জীবন ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যায় জপমালার কবিতা।  ছোটো ছোটো প্রশ্নের তরঙ্গ পাঠায় --



                                                           হাঁটুছেঁড়া ফেডেড জিনসের মতো জ্যোত্স্না...

          জানলার নীচে তখন কালো দুটো শীর্ণ হাত শ্বেতটগরের শুকনো পাতায়

          অ্যালোভেরা জেল লাগাচ্ছে...ক্লোরোসিসে আক্রান্ত এই শ্বেতটগরের পপকর্নগুলো

          তাহলে কারা খেয়ে ফেলল ?



অথবা



                                               যজ্ঞকুণ্ডের পাশে নেভি ব্লু আপেলগাছকে দাঁত বসিয়ে

          আটকে রেখেছে কেউ... কয়েক হাত দূরেই পাঁচজন সুঠাম ধনুর্ধর উত্থিত লিঙ্গের

          মতো তিরগুলো তাক করে আছে আপেলের দিকে... তিরের ফলায় কি বিষ ছিল ?

          সমিধের হলুদ আগুন ক্রমশ নিভে আসছে কেন ? 








                              (২)



জপমালার কবিতায় মাতৃশক্তির এক আদিরূপ গাঢ় স্পর্শে, গাঢ় রঙে, গাঢ় ভাষায় আছে।  নারী হচ্ছে গর্ভ - "তোতা মুইলের ইন উতেরো" (Tota muiler in utero)।  উর্বরতা তার সহজাত শক্তি।  জপমালার কবিতায় এই উর্বরতার কথা উঠে আসে বারবার।  তার কবিতার অন্যতম চালিকা শক্তি এই চেতনা।



          প্রথম যে নারীর যোনিপথ ছুঁয়েছ

          মুখ রেখেছ তার মৌ-টস্-টস্ স্তনে

                                      সঙ্গম করেছ

          (সঙ্গম বলতে যদি সহগমন বোঝাও)

          তাহলে এখনো তার চৌকাঠে পা

          শীর্ণ আঙুল আকাশ ছুঁতে গিয়ে

          থেমে গেছে তোমার গ্রিলবিন্যাসে

          মৃত্তিকাশীতল মৃত্তিকাসহন সে নারী

                            আর তুমি আজও

          ফিসফিস ক্লোরোফিলকথায়

          কী গভীর আসঙ্গে লিপ্ত হয়ে আছ

          সেই ধরিত্রীকন্যার সঙ্গে                (স্বর্গাদপি)



তাই তিনি দেখতে পান



          ১. খোলা বারান্দায়, চাঁদের স্খলিত বীর্যের মধ্যে

                                    লুটোপুটি খাচ্ছে

                              আসিতাভ রাত্রির নাভিমূল     (সম্পর্কিত প্রেমকথাগুলি)



          ২. আমার তো মাত্র দুটো হাত

              একই সঙ্গে আগুনে আর জলে হাত রাখি,

              জল হাত টেনে নেয় তলদেশে মাছগন্ধা মেয়ে

              আগুনহাত অঙ্গার।                              (সম্পর্কিত প্রেমকথাগুলি)



          ৩.            মাঠনাগাল কুয়াশায় দাঁড়িয়ে

                  আমি কী অসহায়ভাবে বলতে চেয়েছি

              অকাল বর্ষায় নুয়ে পরা গর্ভিনী ধানের যন্ত্রণার কথা

                   অতটা বৃষ্টি এনো না যতটা প্লাবন বোঝায়

                         ততটাই আগুনে রাখ হাত

                         যতটা জ্বালবে আলো

               একটা তুলসীগাছের নীচে জ্বেলে দিও না

                          চতুর্দশীর চোদ্দটা প্রদীপ,

                          দেওয়ালি বিষণ্ন হতে পারে



               জঠরের বদরক্ত চুঁয়ে নামছে গর্ভিনীমাঠের

                        ঠ্যাং ভাঙা বিষণ্ন ছাগী তার সাক্ষী         (সম্পর্কিত প্রেমকথাগুলি)



          ৪.       যে কোন সঙ্গম শুধু সঙ্গমেই শেষ হয় না

                       লালায়িত অন্ধকার থেকে উঠে আসে 


                               অক্ষ এবং দ্রাঘিমা রেখা,

                   আহ্নিক এবং বার্ষিক গতি, ঋতু পরিবর্তন,

                                 ভূগোলের চিরকালীন অধ্যায়,

                                               বলেছে এসরাজ।



যৌন অনুষঙ্গ এসব কবিতায় এসেছে এক স্থির অভিমুখ নিয়ে, অতিক্রম করে যাওয়া এক যাত্রায় পাঠককে সঙ্গী করে নিতে।  কোনো নারীবাদের ধরণে প্রতিবাদের ভাষ্য নয়, বরং এই কবিতাগুলি এক শান্ত উদযাপনের, এক আনন্দের।  জপমালার কবিতায় কোনোভাবে যেন এক থেমে যাওয়া বাজনার যন্ত্রের মতো অনুরণন আছে বলে আমার মনে হয়েছে।  যুক্তি দিয়ে এটা হয়তো বোঝানো যাবে না।  অনুভব করতে হবে একে।  বিস্মিত হতে হবে এমন সব লাইন পড়তে পড়তে --




          ১. মাঝরাতে কারা যেন কালো কালো ট্রাঙ্ক নিয়ে

              রাস্তা পার হয়। এই সব ছায়া মানব- এইসব মনস্টার আমার নিজস্ব বাগানে ঢুকে

              পড়ে... নারকেল পাতারা চিরুনি তল্লাসি চালায় বাতাসের গোপন খবরে... ৩৪

              নম্বর জাতীয় সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি কি একটু আরও থামবে না ? ফেলে

              আসা বাড়িটায় আমার কিছু চামচ পড়ে আছে... জানলায় গ্লোবটা রেখে  ঘুরিয়ে

              ঘুরিয়ে খুঁজে পাচ্ছি না বাড়ির মানচিত্র অথচ প্রতিটা কোণ আমার খুব চেনা,

              ওখানে আমি মাকড়সাদের জাল বুনতে দেখেছি...



          ২. দুজনেরই পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে পাক খাওয়া রঙ্গিন

              সুতো... একটা সারেঙ্গি... বাজছে কি বাজছে না বোঝা যাচ্ছে না... কে যেন

              আঁচড়াচ্ছে অন্ধকার বাজনা-গাছ... নখ বেয়ে নেমে আসছে মেরুন যন্ত্রণা...



          ৩. খুব খাড়া কতগুলো সিঁড়ি, তারপরই অন্ধকার ছাদ,

               শুধুমাত্র মুদ্রাদোষে কার যেন গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেললাম



আমার কথা বলি, আমি বিস্মিত থাকলাম।   










শিশিরের নেটওয়ার্ক, দেয়াল ও অ্যাপ্রন  

জপমালা ঘোষরায়, সংযুক্ত 'কালকথা' সংস্করণ, মূল্য : ৫০ টাকা