রূপক চক্রবর্তী ও অগ্নি রায়
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler

আতস কাঁচ ও "পার্ক স্ট্রিট পদাবলী"
তারকোভস্কি'র একটি বাক্য ১০০ শতাংশ সত্যি... "হাজার হাজার মানুষের দ্বারা পড়া একটি বই হল হাজার রকমের বই।"... বিশেষ যখন বইটি হয় কবিতার এবং ছবির লক ডাউনে পড়া বইগুলোর মধ্যে "পার্কস্ট্রিট পদাবলী " এইরকম এক বই, যার প্রচ্ছদ প্রচ্ছন্ন, পাপের স্বর্গীয় ইশারায়...
বইয়ের কবিতা রূপক চক্রবর্তী ও অগ্নি রায়ের।
দুজন ভিন্নধর্মী কবিকে এক মলাটে ধরে রাখার কাজটি চিত্রকর যোগেন চৌধুরীর।
তাঁর সাদা কালো তে আঁকা বেশ কয়েকটি ছবিতে কবিতাগুলি একটি অতিরিক্ত এবং যথাযথ মাত্রা পেয়েছে।
যদিও তিনি বলেছেন, কবিতার সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন তাঁর ' কাপ অব টি ' নয়।
কিন্তু রূপক চক্রবর্তীর কলকাতা নস্টালজিয়া ও অগ্নি রায়ের আত্মগত আধুনিক কবিতার বিভিন্ন লেয়ারের মধ্যে যোগেন চৌধুরির ছবিগুলি কবিতাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে...
ঝাঁপিয়ে পড়া গঙ্গা থেকে নক্ষত্রের মাপজোক। বন্দুকের রসায়ন ও গলির ভেতর উঁকি দেওয়া অবয়ব ... যেমন রূপক চক্রবর্তীর কবিতাকে ভিস্যুয়ালাইজ করতে সাহায্য করে
তেমন, দীর্ঘ রেলযাত্রার মতো মুখশ্রী, পার্কস্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকা ক্রাশ, ও সাদা কালোর অজস্র কাটাকুটি জটিল ছকের বিস্তৃতিতে বিমর্ষ মুখ, ঘিরে থাকা জাল, পদাবলী থেকে উঠে আসা সূর্য ... অন্ধকারে উজ্জ্বল চাঁদ, রাতের জল তরঙ্গে ভেসে যাওয়া ক্রস ও কুমীরের অভিসন্ধি... অগ্নি রায়' এর কবিতায় কবির বিপরীত মুখী দুই বোধের দ্বন্দ্ব নির্ভুল চিনিয়ে দেয়।
দুই কবি ও এক চিত্রকরের সঙ্গে আমরাও অনেকদূর এগিয়ে যাই " ঐতিহ্যশালী পার্ক স্ট্রিট দিয়ে"।
কবি অগ্নি রায় কবিতায় বাস্তব আর কল্পনাকে বিশেষ বিশেষ অনুপাতে ব্লেন্ড করেন,
"স্বপ্নের ভোর কেটে কেটে এগিয়ে আসা নৌকা"র মতো।
দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে উনি নিজস্ব যেসব মেটাফোর খুঁজে পান তাদের কাছে থমকে দাঁড়াতে হয়...
এখানে, ..."কুয়াশা নামে বেপাড়ার মৃদু কলঙ্কের মতো".....
"মরীচগন্ধী সাবালক বাতাসে ওড়ে প্রবাদ গালিচা"
"পৌরাণিক তামাকের গভীর সংকেত"
বিষাদ, রিরংসা ও জীবনের তীব্র আকুতি অনুসরণ করে পাঠককে, বহুদূর, বহুদিন অবধি...
"বঁটিতে শান দেওয়া হত্যা আর কালচে রক্তের দাগ এবার তোমাকে খুঁজতে শুরু করেছে"
.....
সাদা থেকে কালোয় বা কালো থেকে সাদায় পৌঁছতে অজস্র স্তর অথবা রঙের বিস্তার পার হতে উনি বাধ্য করেন....
"মির্জা গালিবের পানীয় থেকে বিষাদ'এর মত উড়ে আসা লাল"
কালো... "শয়তান যেভাবে সেজে থাকে ঠিক সেভাবেই তোমার আই লাইনারও....."
গোলাপী, উভকামী।
'স্মৃতির কাছে অমলতাস' হলুদ....
অন্ধকার থেকে আলোর ঝলকানি অবধি জার্নি
"খাপ আর শূন্যতার অবসরে --- হাইফেন হয়ে ঝুলে থাকা"....অসম্ভব একা এক কবি'র...
ফেলে আসা সময়ের কাছে অনুযোগ,
"খেলা চলার সময় মনে থাকে না
মাঠ ছাড়ার পরের কুয়াশা, শূন্যতা, কৌতুক..."
এবং যেখানে "পার্লার ফেরত মোহিনী মেরি", যখন "ব্যর্থতার ক্লিভেজ শাসন করতে রঙ এবং সাবান উভয়েরই দেরি হয়ে যায়"
সেখানে, প্রেম ও শরীর আসে যথা নিয়মে,...
"রাত বাড়লে পায়ে পায়ে ঘরে ফিরবে
নগর ও তার ব্যক্তিগত নটী"
যদিও, প্রেমালাপ পুরোপুরি বোল্ড আউট করে দেবার মতো...
"তোমার মতন কোনও শ্বাপদ দেখি না"
".....তোমা-বিনা নাশ নেই জেনে
শরীর পাত করে ডেকে ওঠে
রাতের শৃগাল......"
কবির সৃষ্ট শব্দ-বন্ধ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো জারিত বা বিজারিত হয়ে এক নতুন আবহে পাঠকদের নিয়ে যায়, যা ওনার ব্যক্তিগত, নিজস্ব এবং একইসাথে সর্বজনবোধ্য
....
"ফলে ঘুম এসো, এসো ফেনসিড্রিল
চলো উল্টে চেটে খাই হারানো দিন"
আত্মগত কবির সাথে চলতে চলতে পাঠক নিজের অজান্তে
কবিতার অংশ হয়ে উঠতে পারেন....
"পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারবে নির্ভয়ে পরস্পরের আঙুল আগলে রাখা দুটি শীতার্ত মানুষ"
.....
কলকাতায় এবং সম'এ ফিরি আর একবার।
কবি রূপক চক্রবর্তীর কবিতায় "পার্কস্ট্রিট পদাবলী " শুরু।
কলকাতার রক্ত মাংস মজ্জা হৃদয় আত্মায় নিমগ্ন এক কবির স্বগতোকথন... যে কোন কলকাতাপ্রেমী পাঠকের স্মৃতি উসকে আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট।
প্রেম, সুর, বিপ্লব, বেশ্যা, বন্দুকের কলকাতাকে চেনা - অচেনা বাসিন্দাসমেত আঁকড়ে ধরতে পারেন পাঠক। আরও একবার....
এ শহরের শৈশব বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মুঠো করে ধরে নেয় খসে পড়া তারা।
প্রৌঢ়ত্বের বিদায়ের দুঃখী ছায়া পড়ে ' রানীকুঠি পুকুরে '।
ধুম লাগে হৃৎ কমলেই। বকুল মাসীরা অভিমানী চিঠি ডাকবাক্সে রেখে যায় ছায়া'দের নাম'এ।
শহরতলির "পায়রার মমি " ছন্দ জানে কি?
"কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ" থেকে সত্যিই ঝরে "একফোঁটা অশ্রু"?
মধ্যবিত্ত নক্ষত্র গড়াগড়ি দেয় চিংড়ি - ইলিশ, সুনীল - শক্তি উদর - নেত্রপীড়া সম্বলিত রাশিফলে।
কখনো, সাধারণ দৃষ্টি থেকে, সাধারণ স্বপ্ন থেকে বহু দূরে.... কবির আশ্চর্য কলকাতা।
সে কলকাতা আড়ালে চোখে জল এনে দেয়... কলম ছুঁইয়ে লেখা যায়, "....ঘাসে শুয়ে রয়েছেন আমির খান। গঙ্গাকে তানপুরা হিসাবে ধরেছেন"...
এবং চেনা পাহারাদার।
চেনা, বেপাড়ার বোকা মেয়েদের ভালোবাসা কিংবা কাচ থেকে একটু দূরে " আন্তর্জাতিক সাবানের গন্ধে" কারো ঘুম ভাঙার মূহুর্ত ।
শিশি বোতল, লোহা ভাঙা, "জেরক্স করার লোকটিকে " পেরিয়ে ৬ কোটি বছরের জীবাশ্ম... সুলেখার মাঠ. ...আবশ্যিক প্রেম।
"বাতাস আজ হিরন্ময়। আকাশ আজ অপরাজিতা ফুলের মতো নীল।"
কোনও সুলেখা এ লেখা পড়বে কি?
কলকাতার পেটের ভেতর বিচিত্র কলকাতায় সাত্ত্বিক মদ্য ব্যবসায়ী রামলখন-- খদ্দের ফেলে গল্পে মশগুল বিনুনি - খোঁপার যৌবন... সন্ধ্যেরাতের খুনখারাপি... অদল বদল করতে চাওয়া অসম বয়সের বন্ধুত্ব....
এ সকল অনুষঙ্গে মনে পড়তে বাধ্য গড়িয়া থেকে দমদম অবধি বয়ে চলা দিন রাতের সিল্যুয়েট , যেখানে কোনও বিন্দু হয়ে একসময় আমি'ও ছিলাম