সরস ও সারসী এবং কেন

 


পরিযায়ী পাখি দেখলে জটায়ুর কথা মনে পড়ে। ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করে নিই ওদের কাছ থেকে, জটায়ুদের সন্ততিরা কেমন আছে গো? কেউ কি আছে এখনো বর্তমান তাদের বংশের? জানো ? বোধহয় সেটা আন্দাজ করে খোনা খোনা গলায় ওমনি কিছু ট্রুর্ র্ র্ ট্রুউউর্ র্ র্ র্ শুনিয়ে দিয়ে উড়ে গিয়ে বসে দূরের অন্য কোনো ডালে। মাঝে মাঝে এক দুবার আমার দিকে তাকিয়ে যেন বোঝাতে চায়, বহুদূর সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে তারা এই ময়না বিলের মধ্যে জল সমাধি নেওয়া মরা গাছের পাতাহীন ডালে ডালে এসে উঠেছে ঋতু-খানিক বিশ্রাম নিতে, আমাকে গুষ্টির গল্প শোনাতে নয়। তাই চুপ করে চেয়ে থাকি ।

 

ময়না বিলের ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মাথায় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে পরিচিত  বিকেল গড়িয়ে যায় । হাজার আটটা প্রদীপ যেন আহ্লাদে আট খানা হয়ে নেচে নেচে এপার থেকে ওপার দুলকি চালে চলেছে। ধবধবে সাদা সাইবেরিয়ান সারস পরিবার কেবল দৃষ্টি কাড়ে কেন বুঝি না । মনে মনে হয়, ওরাই হবে, ওদের সাথেই একমাত্র ভীষণ ভীষণ মিল। ওরা ঠিক জানে কিন্তু কিছু বলবে না, আর কিচ্ছুটি জানাবে না একেবারে। কারণ হিসেবে মনে হয় কাণ্ডের ভিতরে তার উত্তর রয়েছে, যে উত্তর কাণ্ড জটায়ু দেখার আগেই প্রাণ দিয়েছিলো বলে খেলাচ্ছলের আঘাত তার লাগেনি।  মাজা রঙের বামুন বউয়ের মতো হাঁসগুলো  সন্ধ্যার উলু দিল বুঝি ছোট ছোট লেজ ঝটপটিয়ে। ওদের ঝাপটেও যেন চাপা ধমক - কেন অত জানতে চাওয়া বাপু? জটায়ু সেসব কিছুই দেখেননি। 


শাঁওলি এক মেয়ে তার অন্ধকার আঁচলে ঢেকে নেয় সমস্ত ময়না বিল । মাঝে মাঝে অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে সাদা সাদা ডানাগুলো মেলে দিয়ে  আবার বন্ধ করে তার মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে জটায়ুর সম্ভবত সন্ততিরা । এবারের দীর্ঘ শ্রাবনে দ্বিতীয়বারের চাঁদ থালার মতো হবে এরকমটাই জানি । একটু একটু করে জাগছে সে ময়না বিলের উপর অন্ধকার আঁচল সরিয়ে। 


এরকম নীল চাঁদের রাতে কী ভাবতো সেই গহীন অরণ্যে একলা পুর্ণগর্ভা নন্দিনী ! কে তুমি‌ ? পদ্মা , বেদবতী অথবা রম্ভা জীবনে আগুনকে ছাড়া আর কাউকেই তো দেখি নি তার নিজের ভিতর তোমাকে লুকিয়ে নেওয়ার মতো লোক। সেই ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচিয়ে নেওয়ার মতো লোক । আর ধর্ষকের ভূমিকায় কিন্তু বারবার সেই একই রাক্ষস। ধর্ষকদের  প্রবল হতে হয় রাক্ষসদের প্রবল হতে হয় না  হলে নাটক জমে না । প্রবল রক্ষাকর্তা হতে নেই কেবলমাত্র স্বামীকে ! কেন?


ময়না বিলের জলে রূপালী চাঁদের থালা গলে গলে পড়ছে। সারস দম্পতিরা ডানার ভিতর থেকে মুখ তুলে এবার একদৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। তুমিও কি এভাবেই দেখতে একবার চাঁদ আবার পরক্ষনে তোমার পুর্ণগর্ভের দিকে ? এই দীর্ঘ শ্রাবনের মতো তোমার ভিতরেও ছিল জোড়া চাঁদ, তোমার জমজ সন্তান। কোথায় রয়ে গেছে তাদের বাবা? কেন? 


মৃত গাছ সেই ময়না বিলের জলে তার উপরেও গলানো চাঁদের পরত। তাতে অবশ্য ওর কোনো হেলদোল নেই। সে তবু এখনো তার শাখায় পাখিদের আশ্রয় দেয় । যেমন আশ্রয় দেয়  রাজা । অনেকটা সেরকম রাজার মতো। প্রতি যুগে প্রভু প্রজাপালক শুধুমাত্র ভগবান।  লক্ষ্মী মেয়ে নন্দিনী তুমি প্রভুর পা দুটো থেকে ক্রমাগত ধুলো সরাচ্ছো কেবল। তবুও শান্তির উপর ধুলোর পরত সরে না আজও । অধরা থাকে সে জাগতিকের কাছে । খেলা চলছে খেলাচ্ছলে । জটায়ু এসব সত্যি কিছুই দেখেননি । 


জলজ উদ্ভিদের মৃতদেহ জড়ো করে ওই জলের উপরেই এক খণ্ড ভুমিকা তৈরি করে প্রকৃত সারস তার আগামী প্রজন্মের জন্য । সারাজীবন একই সঙ্গীর সঙ্গে উড়ে উড়ে বহু দূরে বাসা বোনা । ডিম পাড়ে তা দেয় একই জলাশয়ের লতাগুল্মের জড়ো করে । এই সারস জটায়ুর কেউ হয় না। হয়তো বা কন্ডরদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী হবে । কিন্তু আশপাশের চাষীদের শষ্যক্ষেত এর ফসল অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে এরা রক্ষা করে জটায়ুর মতোই । 


নন্দিনী... নন্দিনী... সোনার ফসল... তোমার জন্য প্রেম যে ছিল না.... কেন ?


খণ্ড খণ্ড প্রশ্ন আছে কেবল তার উত্তর খণ্ডটুকু নেই ।