মোনালি রায়
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler

সেলোফেন বাঘ, ফয়েল তলোয়ার
মোনালি রায় , ছবি : মেঘদূত মিত্র
এক নির্মল জঙ্গলে ছিল ছায়াময় জংলী দিঘি । চিন্তাশূন্য বন্য জন্তু । মাথার উপর নীল আকাশ ও উড়িবার মত পাখি। জল, রোদ, হাওয়া, কুয়াশা ঘিরিয়া তাহা ছিল দিব্য অরক্ষিত অঞ্চল ।
এই সময়ের সকল জঙ্গল যেমত বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত, সেইমত কিছু নহে। জঙ্গল চিরিয়া ট্রাক চলিবার রাস্তা , নজরদারি ক্যামেরা বা গণনার চিহ্নবাহী চিপ ইত্যাদির প্রশ্ন ছিল না।
অভয়ারণ্য চাখিয়া দেখিতে চাওয়া হুমদোমুখো পর্যটক ছিল না। ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বজায় রাখিবার তাগিদে মেকি জল, খাবার ইত্যাদির বন্দোবস্তও জাস্ট না।
ছিল, শিকার। শিকারী। ডাকাত। নিরীহ নিরুদ্দিষ্ট, সাধুসন্ত ইত্যাদি প্রভৃতি।
সেই অনন্যকল্প জঙ্গলটিতে এক বাঘের মুখে এ কালের এক সাদামাটা ক্যামেরা জুম ইন করিতে করিতে দেখিতে পাইলাম, বাঘটি বেশ চকচকে, প্লাস্টিক প্লাস্টিক ভাবের, তথা নকল!
বিস্মিত ও হতাশসম হইয়া ক্যামেরাটি জুম আউট করিয়া ইতিউতি দেখিতে লাগিলাম ।
ও হরি! হুবহু জঙ্গলের ন্যায় জঙ্গলটি আসলে জঙ্গল নহে।
অভয়ারণ্য তো নহেই।
ইহা অতিযত্নে সাজানো এক চতুর বাগান। ভাবে মালুম হয়, শীঘ্র জনসাধারণের নিমিত্ত জঙ্গল থুড়ি বাগানটিকে উন্মুক্ত করা হইবে। এই যুগের ছানাপোনা আদি সত্য-দ্বাপরের আভাস পাইবে, তাহাই কি কম কথা!
থাকিতে থাকিতে বুঝিলাম, এই স্থলে কোন এক প্রযুক্তিতে, সপ্তাহান্তে সময়'কে বারংবার একই ছন্দে ঘুরাইয়া আনা যায়....
অর্থাৎ, সপ্তাহের সব কটি রবিবার একই কার্যের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়া থাকে। প্রতিটি বুধবার একই রঙ্গে বারংবার ফিরিয়া আসে বুধবারে --
এক সপ্তাহের রবি সোম হইতে অন্য সপ্তাহের রবি সোম'এর কার্য প্রণালী বদলাইতে হইলে সম্ভবত ভয়ানক হাঙ্গাম। তজ্জনিত, এই ব্যবস্থা।
তা, এ হেন সুগভীর সুকৌশলী জঙ্গলে বাঘ ছিলই, বলিয়াছি। তাহার সহিত হরিণ, ময়ূর, শেয়াল, কুমীর, নেকড়ে, স্পেশাল এফেক্টস সকলই ছিল৷
তীর ধনুক বল্লম ইত্যাদির সহিত ছিল তরুণ রক্তলোলুপ এক তলোয়ার। ঝকঝকে পুরুষ্টু। শিকারীর হস্তে তাহা ঝলকাইয়া উঠিলে চন্দ্র - তারকাগণ স্বীয় স্বীয় অনুজ্জ্বলতা ঢাকিতে চাহিতেন বলিয়া প্রতীয়মান হয়।
অথচ নিগূঢ়ভাবে নিরীক্ষণ করিলে বোঝা যায়, এ ঝলকানিতে যত ঝাঁঝ, তত ধার নাই। তলোয়ারটি নেহাতই এ কালের ফয়েল নির্মিত ।
এবং শিকারী, সেই তলোয়ার লইয়াই শিকার করিয়া থাকেন ফি শনিবার। হেথায় শনিবারের রাত হয় অমাবস্যার। চন্দ্র তারকা রহিত। অপর দু এক শিকারী আবার শব্দভেদী বাণ ছুঁড়িতেও সক্ষম । সে কাহিনী পরে। শুধু বলিয়া রাখি,মোম- নির্মিত শিকারীগণ মাদাম ত্যুসোর পুতুলতুল্য, অন্য কিছু নহেন।
আমি কোন গুপ্তমন্ত্রছলে এই আসলের অনুরূপ নকল জঙ্গলে বাঁধা পড়িলাম, সেও বিস্তর জটিল বিষয়। যথা সময়ে বিশদে কহিব।
আপাতত বলি, সিসিফাস'কে কে না চেনেন!
নর্স মাইথোলজির 'ভালহালা' অথ “hall of the fallen” এর চর্চাও আমরা, সাধারণ জনে করিয়া থাকি -- সে জায়গাটি অনেকটা আমাদিগের নরক' তুল্য। নিজ নিজ পাপের ফলস্বরূপ বীর-যোদ্ধাগণ মৃত্যুর পর ভালহালা'তে আমন্ত্রণ পাইতেন। নাগাড়ে লাগাতার যুদ্ধে প্রবৃত্ত থাকিবার নিমিত্ত। প্রতি যুদ্ধে মরিবার পর তাঁহাদের জাগিতে হইত। যুদ্ধের ডাক আসিত, আবার। যুদ্ধ - যন্ত্রণা - মৃত্যু - জাগরণ - যুদ্ধ চলিতেই থাকিত -- এখনো নিশ্চিত চলিতেছে...
অথবা, বিক্রমাদিত্য ও বেতাল'কাহিনী মনে নাই, এমন কেহ কি আছেন! প্রতিবার বেতাল, তাহার গল্পের ফাঁদে ফেলিয়া বিক্রম'কে কি প্রকার বাধ্য করিত, ( তাহাকে স্কন্ধে বহন করিয়া একই পথে লইয়া যাইবার) একই কার্যে মনোনিবেশ করিতে, আবার এবং আবার
....
ফিরিয়া আসি বাঘ - প্রসঙ্গে। যাহার জন্য কুলুঙ্গি হইতে এত কথা নামাইয়া আনিলাম
গতিবিধিতে বুঝিলাম, এই বাঘটিকে জঙ্গল প্রলোভিত করে, তাহার রূপ রস গন্ধে। যদিওবা প্রলোভিত হইবার সদিচ্ছা এই নকল বাঘের সত্যিই আছে কি না, আমার অতি সাধারণ ক্যামেরা চক্ষু তাহা ধরিতে পারে নাই। তবু উদাসী বাঘ, সুখী বাঘ, লোভী বাঘ, রাগী বাঘ, দুঃখী বাঘের নানান ছবি নিজ দক্ষতায় উঠাইয়াছি বই কি।
দু - একদিন যাইতে না যাইতেই জন্তুগুলি সম্বন্ধে আমার ভীতি কাটিয়া গিয়াছিল। তাহারা মন্ত্রমুগ্ধ আবিষ্টমন প্রাণী যেন! অদৃষ্ট যাহা স্থির করিয়া রাখিয়াছে তাহার বাহিরে নড়িতে চড়িতে পারে না বা চাহে না !
রুটিন অনুযায়ী, বাঘটি প্রতি রবিবার আকাশের দিকে চাহিয়া বৃষ্টির নামিয়া আসিবার শব্দ শুনিবে।
প্রতি সোমবার একটি ময়ূর শিকার করিবে ( ময়ুরটি যথারীতি পরে জীবিত হইয়া যাইবে)
মঙ্গলের ঊষালগ্নে এক সাধুর কুটীরের নিকটে বসিয়া ভৈরবী রাগের সহিত নিজ-স্বর মিলাইবার চেষ্টা করিবে... গমদদপ আলুম"
বুধবার' এক শিকারীর জাল ছিন্ন করিয়া পলায়নপর হইবে। ( কোনও মূষিক তাহাকে হেল্প করিবে না, বলাই বাহুল্য)
বৃহস্পতিবার তাহার রেস্ট ডে। অদৃষ্টের সূক্ষ্ম যান্ত্রিক হাত আসিয়া তাহার মেরামত করিয়া, প্রয়োজনমতো নতুন সেলোফেন ও রঙ লাগাইয়া যাইবে।
শুক্রবারে হরিণ শিকার। ( এই কালে আপন মাস'এ হরিণ - হরিণী উভয়েই বৈরী)
এবং শনিবারের সূর্য অস্তাচলে যাইবার পর উপস্থিত হইবে অমোঘ সময়। যথায় সিসিফাসের সাময়িক কর্মবিরতি। ভালহালা'র টেলি প্রদর্শন ---
সারা হপ্তা তক্কে তক্কে থাকিয়া ঠিক শনিবারের সন্ধ্যাটি নামিলে মোমের শিকারী তাহার সুঠাম ফয়েল তলোয়ার লইয়া অদৃশ্য অন্ধকার হইতে রে রে করিয়া দৌড়াইয়া আসিয়াই এক কোপ বসাইয়া দিবে। ( বাঘ মারিবার এমন উপায়, পূর্বে বিশেষ শুনি নাই! )
প্রতি শনিবারের সন্ধ্যায়... পুরাকালে বঙ্গ দূরদর্শনে বিজ্ঞাপন সহ বাংলা সিনেমার টেলিকাস্ট যেমত অবধারিত ....সেইমতো তলোয়ারটি ঝলকানি দিয়া নিখুঁতভাবে উড়িয়া আসিয়া নির্মম বসিয়া যাইবে চকচকে-সেলোফেনি বাঘের গলায়।
বাঘটি তলোয়ার সমেত যন্ত্রণা ক্লিষ্ট শরীরে ঝাঁপ দিবে ঠিক এক হস্ত তফাতে অবস্থিত জলাশয়ে।
এবং ডুবিয়া যাইবে ।
জরুরি নোট - জলতলের গভীরে নিশ্চিত মেরামতি কারখানা আছে ( তথায় ক্যামেরা যায় না)
.....
*** (( সঙ্গের ছবিগুলি মেঘদূত মিত্র নামক ৫ বছর বয়সী এক বিজ্ঞের যিনি ডলফিন ও চকোলেট একইরকম ভালবাসেন ))