অঞ্জলি সেনগুপ্ত
লেখক / সংকলক : iPatrika Crawler

আউলিয়া ভোর
অঞ্জলি সেনগুপ্ত
রাত ভর পথ হেঁটে চলছেন এক বিভোলা ফকির । টলমল কদম । হাঁটুর উপর দেড়হাতি সাদা বস্ত্রে শরীরের নিম্নাঙ্গ ঢাকা । সামনে উত্তাল ভাগীরথী । কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই ফকিরচাঁদের । আনমনা ফকির কদম বাড়িয়ে হেঁটেই চলেছেন , দৃষ্টি সুদূরে , আকাশ ছাড়িয়ে অন্য আকাশে । খোঁজ খোঁজ ... কী খুঁজেন ? কাকে খুঁজেন ... কোন অধরার মোহ ঘোরে জন্মবিবাগী ফকির ছিন্ন কাঁথা গায়ে বিভোর হয়ে পথ চলছেন পথের খোঁজে । হাঁটছেন তো হাঁটছেন-ই ...। পায়ের নিচে জমি না পাত্থর , গাছ না তৃণ , স্থল না জল সেই বোধ অবধি নেই । আত্মলীন,বিভোলা ফকির । বুকের ভিতরে সর্বনাশা সুরে বংশীর টান । কে টানে , কে ডাকে ? বোধ জ্ঞানহীন বিভোলা ফকির হাঁটতে হাঁটতে উলঙ্গ চরণে পেল শীতল স্পর্শ । গঙ্গার জলের উপর চরণ পড়ল ফকিরের । বাহ্য জ্ঞান গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছে এক্কেবারে । ফকির চলল একদিশায় । ওমা , জলে চরণ ডুবল না যে । কী আশ্চর্য ! ফকির জলের উপর টলমল পা ফেলে এগিয়ে চলছেন গন্তব্যের টানে । স্থল জল ফকিরের কাছে বশ মেনেছে কোন জাদুবলে ? একাকার , সব একাকার ।
ভোরের ঊষামায়াকে স্তব্ধ করে, পৃথিবীকে বিস্মিত করে ফকির জলের উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে গেলেন উত্তাল গঙ্গা ।
গঙ্গা পেরিয়ে ফকির চলছেন এ কোন দিকে । সূতানটি গোবিন্দপুর তাঁর গন্তব্য তো নয় ! বাতাস বইছে নির্মেঘ চলনে , রুদ্ধ চলনে । ধীর স্তব্ধ আশপাশ । গৌর বর্ণ মুখমণ্ডলে রক্তিম আভা । দৃষ্টি কেন জলজ ? নীরদ মেঘ যেন স্তব্ধ হয়ে আছে দুচোখের গোলার্ধের আকাশ জুড়ে । টলমল চরণেও গতি স্থির ।
দুমিনিট থমকে দাঁড়ালেন ফকির । কাঁধের ঝুলি থেকে বের করে আনলেন একটি পুরাণো শঙ্খ । মাখন রাঙা শঙ্খটি নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেলেন ফকির । শাঁখ ডুবে গেল হস্তসহ গভীর গঙ্গায় । উঠে এলো নীরমণ্ডিত হয়ে । ওই নীর গলা উর্ধমুখী করে ঢক ঢক করে পান করলেন ফকির । অতঃপর ঝোলাটি মাথার উপরে বেঁধে নদীর শীতল শরীর ছেড়ে ডাঙ্গায় চরণ রাখলেন । অচিন দেশের অচিন মানুষ অচিন প্রেমের সন্ধানে
নদীবক্ষের থেকে উঠে এলেন ফকির । আশ্চর্য , দীর্ঘ জলভ্রমণেও মাথায় বাঁধা ঝুলিটি পর্যন্ত শুষ্ক । দীর্ঘ গৌর শরীরে একবিন্দু জলের ফোঁটাও নেই । শুষ্ক শরীর । ফকির তীরবেগে তট ধরে পূর্ব দিকে চলতে শুরু করলেন । চোখে নব অস্থিরতা । মণিকর্নিকা ঘুরছে এদিক ওদিক । প্রাণের ভিতরে কলোচ্ছ্বাস । শোণিতে শোনিতোচ্ছ্বাস । বুকের স্পন্দনে দ্রিম দ্রিম শব্দে গেয়ে যাচ্ছেন সত্যনাম । সত্যই কেবলম ! সত্যই বর্তমান ! সত্য চরণ সার ... । এবার সত্যের বিকিকিনি হবে সস্তাদরে । হোক হোক অপযশ , শ্যাম দরশনে মন যে বিবস , রসিকের সন্ধানে ব্যাকুল রসিক মন ।
থলি ভরা মনি মুক্তো , দেবেন কারে ? ভবে কে আছে পাগলা , ওরে সহজ প্রেম সস্তাদরে দরদ করে নেবে কে ? প্রেম বুভুক্ষু অন্তর খুঁজে আত্মহারা প্রেমিকজন । বিধির অগোচরে প্রেমের ফকির আউল বাউল হয়ে পথকে করেছে ঘর , ঘরকে করেছে পর ।
জনমানব থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে , ‘ওগো কাহার নন্দন তুমি , কি নাম তোমার’ ?
অচিন পথিক ভাব তন্ময় চোখ দুটি তুলে কেবল বলে ,’ কিছু কি ধারিস’ ?
দুইগাল বেয়ে জল ধারা নামে । দীঘল কেশ অযত্নে ঘাড় ছাপিয়ে পিঠে লুটো পুটি খায় । ফকির আউল হয় , বাউল হয় । কাঁদে প্রেমের যাতনায় । ওরে নামা তোর প্রেম ভার ? ফকির পরম উৎসাহে আবার সুধে, ওরে ধারিস কিছু ...’।
বাতাস নিরুত্তর ।