গর্দিশ


 



অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়



চার মাস পর
দিল্লি শহরে তোপ দাগার শব্দ শোনা গেল ভোর হবার সাথে সাথে
পূব আকাশে সূর্যদেব উঁকি দিলেই
তোপ দাগার এই রেওয়াজ ইংরেজ হুকুমত কায়েম হবার থেকে নিয়মিত
শহরের ভদ্র,সচ্ছল পরিবারের
লোকেরা তোপের আওয়াজ শুনে আস্বস্ত হল। যাক! এতদিনে তাহলে তিলঙ্গা সিপাইয়েরা
পর্যুদস্ত হয়েছে ইংরেজ সরকারের হাতে। লুটতরাজ আর খুনোখুনির আজ অবসান হল। শহর
দাপিয়ে, লুটের মাল হাতিয়ে, হটাত বড়লোক হয়ে ওঠা গুন্ডা মাওয়ালির দল প্রাণ যাওয়ার
ভয়ে গা ঢাকা দিল। কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচল শহরের বাইরে। দুর্বল গরিব মানুষেরা— যারা এতদিন
শুধু লুটপাটের মজা দেখছিল আর ধনীদের পর্যুদস্ত হতে দেখে মজা লুটছিল, তাদের মনে
কোনও হেরফের হল না
কিন্তু লাল কেল্লার ভিতরে ঘটে যাওয়া ঘটনার গুজব হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল শহরে। আজ
আবার সকাল হতেই তোপের আওয়াজে কারো জানতে বাকি থাকল না— বাদশাহ্‌ বাহাদুর শাহ্‌ জাফরের
নেতৃত্বে লড়তে থাকা সিপাইয়েরা অবশেষে হার মেনেছে। পুনঃ বহাল হয়েছে ইংরেজ শাসন।



কেল্লার অনুদানে পুষ্ট শহরের ধনী সম্প্রদায় অবশ্য তোপ দাগার আওয়াজ শুনে প্রমাদ
গুনল
এবার তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যারা সরাসরি বাদশাহের বেতনভোগী ছিল, তারা
আগুপিছু না ভেবে শহর থেকে পালাতে লাগল। শহরের বাইরে গুজ্জরদের হাতে কারো প্রাণ
গেল, কেউ হয়ে গেল সর্বস্বান্ত। ভাগ্যবান যারা— তারা কেউ অন্য জায়গায় পালিয়ে গিয়ে নতুন
করে বাঁচার আশায় দিন কাটানোর স্বপ্ন দেখতে লাগল
দিল্লি শহর খালি হয়ে গেল
রাতারাতি। দলে দলে বিদ্রোহী সিপাইদের ধরে ধরে গারদে পুরল ইংরেজ বাহাদুর।



            যেদিন থেকে মেরাটের সিপাইয়েরা কেল্লার
দখল নিয়ে মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ্‌ জাফরকে তাদের দলনায়ক বানিয়েছে, সেদিন থেকেই এই
শহর সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কে যে সিপাইদের দলে, আর কেই-ই বা
ইংরেজদের গুপ্তচর —বোঝা দায়। চাঁদনী চকের ধনী ব্যবসায়ীদের দোকান লুট হয়েছে। শহরের
বাইরে থেকে আসা লুটেরারা শহরের অলিতে গলিতে উল্লাসে মেতেছে। কেল্লার উঁচু পাঁচিলের
উপর থেকে মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণের শব্দে আর সেনা ব্যারাকের দিক থেকে হাওয়ায় ভেসে
আসা বন্দুকের আওয়াজে শহরের মানুষের শান্তিভঙ্গ হয়েছে দীর্ঘ কয়েক মাস জুড়ে। আজ
কেল্লা থেকে তোপ দেগে দিনের সূত্রপাত যেন নতুন এক যুগের সৃষ্টি করল, হয়ত বা এক
যুগের অবসান হল। সেই যুগাবসান গৌরবময় অধ্যায়ের শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিল কিনা, কেউ সে
কথা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করল না।  



            সেনা ছাউনিতে আজ বড়ই ব্যস্ততা।
ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হডসনের সেনাবাহিনী চারমাস বাদে সিপাইদের কেল্লা অবরোধ অবশেষে
ছত্রখান করে দিয়ে কেল্লার দখল নিয়েছে। বহু সামরিক ও অসামরিক ইংরেজ নিধন হয়েছে এই
কয় মাসে। তাই ক্যাপ্টেন হডসন প্রতিহিংসায় জ্বলছে। রাতের আঁধার কাটার অনেক আগেই সে
তৈরি তার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। হডসন একজন সুদক্ষ সামরিক অফিসার— প্রাণ নিতে যার
বিন্দুমাত্র হাত কাঁপে না। নিষ্ঠুরতার জন্য সেনাবাহিনীতে তার বেশ নামডাক আছে। অধস্তন
সেনারা যেমন তাকে ভয় পায়, ঊর্ধ্বতন অফিসাররা তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে, কারণ কাজে
তার নিষ্ঠা আর পরিশ্রম— ঈর্ষা জাগায়।



            হডসনের গুপ্তচরেরা খবর দিয়েছে কেল্লা
থেকে উধাও দিল্লির শাহেনশাহ— বাহাদুর শাহ্‌ জাফর। সাথে আছে তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন
পুত্র, পৌত্র আর আমীর ওমরাহ্‌। কেল্লার ভিতরে ঘটে যাওয়া কোনও খবরই হডসনের অগোচরে
নেই। বাদশাহের শ্বশুর মীর্জা ইলাহি বক্সের সাথে সরাসরি সংযোগ বিদ্রোহের সূচনা
থেকেই আছে। জাফরের আর এক কাছের মানুষ মৌলবি রজব আলি নিয়মিত হডসনের উৎকোচ পেয়ে
থাকে। তাই কেল্লার প্রতিটি গতিবিধি যথাসময়ে হডসনের কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। জাফরের
গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় জেনারল উইলসনের মোহর লাগালে আর কোনও অসুবিধাই নেই। একবার যদি হিন্দুস্তানের
পুতুল বাদশাহকে জালে ধরে ফেলা যায়, তবে হডসনের পদোন্নতি কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু
জেনারল উইলসনকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল
লোকটা একটা আস্ত কুঁড়ে, তজ্জলদি সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট সময় লাগে বুড়োর আর হডসনকে যে সে পছন্দ করে না, তা প্রতি সাক্ষাতে উইলসনের দেহের ভাষায় তা সুস্পষ্ট
ভাবে ফুটে ওঠে।



            জাফরকে গ্রেপ্তার করার হডসনের প্রস্তাব
শোনা মাত্র নাকোচ করে দিলেন জেনারল উইলসন। তার মতে— বিদ্রোহের যে আগুন দিল্লি আর
মেরাটে জ্বলে উঠেছে, জাফরের প্রেপ্তার তাতে আগুনে ঘি ঢালার সমান। গোটা
হিন্দুস্তানে চাপা অসন্তোষ ভয়াবহ আকার নিয়ে ইংরেজ হুকুমতকে ভিত থেকে নাড়া দিতে
পারে। কিন্তু নিজের প্রত্যয়ে দৃঢ় হডসন নানা যুক্তি দিয়ে জাফরকে গ্রেপ্তার করার
পরোয়ানা লিখে দিতে বাধ্য করে উইলসনকে। পরোয়ানা পত্রে সই করে দেবার আগে উইলসন
হডসনের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “বাট, ইউ আর নট সাপোস্‌ড টু শুট হিম।
আন্ডার এনি সারকামস্ট্যান্সেস, দ্য শাহেনশাহ শুড নট বি হার্মড্‌!”



হডসন জেনারলকে আস্বস্ত করে, “সারটেইনলি স্যর! জাফরের শেষ স্ত্রী জীনত মহলের
সাথে নিভৃত সাক্ষাতকারে অনেক আগেই আমি তাকে কথা দিয়েছি, ব্লাডি শাহেনশাহকে গারদে
ভরে দিলেও তাকে জানে মেরে ফেলা যাবে না।”



            জেনারল উইলসন পরিষ্কার বুঝতে পারেন
হডসন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছে। আর যাই হোক, তার পরিশীলিত অভিজ্ঞ মন কিছুতেই
হিন্দুস্তানের বাদশাহ আর তার পরিবারের কোনও ক্ষতি চায় না, কারণ তিনি জানেন অশীতিপর
বৃদ্ধ জাফর কেবলমাত্র পরিস্থিতি আর রাজনীতির শিকার। প্রেপ্তারি পরোয়ানায় নিজের
সাক্ষর দিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত হয়ে হডসনকে বিদায় দেন উইলসন



 



লাল কেল্লার
অসুরক্ষিত দিল্লি দরজা দিয়ে রাতের অন্ধকার কেটে যাবার অনেক আগেই বাদশাহ জাফরকে
নিয়ে ছুটে চলেছিল তার পালকি। সাথে কয়েকজন বিশ্বস্ত সিপাই। তখনো কেল্লার দখলদারি
ইংরেজদের হাতে আসেনি। বাদশাহের ইশারায় পালকি ছুটে চলেছে মেহ্‌রৌলী
কুতুব শাহের দরবারে মাথা ঠেকাবেন জাফর। আজ তার যা কিছু ছিল, সবেরই অবসান। মোগল
পরাক্রম অস্তমিত। পিতৃপুরুষ মোগল শাসকদের কাছে তিনি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
নিজের ভবিষ্যৎ যে গাঢ় অন্ধকারে, অনিশ্চিত তার পরিবারজনের জীবন, তা তিনি অনেক আগেই
বুঝেছিলেন। ইংরেজ শাসকদের মোগল পরিবারকে অবহেলা করা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে
গিয়েছিল
সিপাইদের বিদ্রোহ মোগল শাসনের অবসান ঘটাল দ্রুত। বাদশাহ তার দুর্ভাগ্যকে
অভিশাপ দেন না
আধুনিক দুনিয়ায় শক্তিশালী ইংরেজ হুকুমতের বিরুদ্ধে কোনও শক্তিই যে টিকবে না,
সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন। আপাতত কুতুব শাহের দরগায় প্রার্থনা করে সুযোগ বুঝে
মক্কায় যাত্রা করবেন বলে স্থির করেন বাহাদুর শাহ্‌ জাফর।



            জাফরের পাল্কির পাশে দৌড়তে দৌড়তে এসে
মৌলবি রজব আলি খবর দেয়, “কুতুবের দিকে যাওয়ায় বিপদ আছে জাহাঁপনা। পথে গুজ্জর
ডাকাতের দল সকালের আলো ফুটতেই বাদশাহি পাল্কি দেখে ছেড়ে দেবে না। এই কটা হাতে গোনা
সিপাইয়েরা ওদের মোকাবেলা করতে পারবে না।”



            থেমে যায় জাফরের পাল্কি। বাদশাহ
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে, বিপদ অনুমান করে পাল্কি ঘোরাতে বলেন নিজামুদ্দিন দরগার দিকে।
সেই রাস্তা কিছুটা হলেও নিরাপদ। জাফরের পাল্কি নিজামুদ্দিনের দিকে ঘুরতেই রজব আলি
অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়। তার মুখে কুটিল হাসি ফুটে ওঠে। জাফরের নিজামুদ্দিন যাবার
খবরটা এখুনি ক্যাপ্টেন হাডসনকে দিতে হবে। তবেই না মিলবে অনেক ইনাম! বাদশাহর নুন
খেয়েছে তাদের অনেক পুরুষ, কিন্তু মোগল শাসনের গৌরবময় সূর্য যে আজ পশ্চিম আকাশে ঢলে
পড়েছে, তা দিল্লির গলিতে খেলে বেড়ানো ক’দিনের বাচ্চাটাও জানে। গোপনে ইংরেজ
সেনাশিবিরে খবর বিক্রি করা রজব আলির নতুন পেশা।



            সিপাইদের একটা দল কেল্লার দিকেই
আসছিল। বাদশাহি পাল্কি দেখে তাদের দল থমকে দাঁড়িয়ে জাফরকে কুর্নিশ করে। তারা খবর
নিয়ে এসেছে বাদশাহর পুত্র মীর্জা মুঘল ঘুরপথে যমুনায় নৌকায় পাড়ি দিয়ে হুমায়ূনের
মকবরায় আপাতত আশ্রয় নিয়েছে। জাফর স্বস্তি পান। তারপর পাল্কি আরও জোরে ছুটে চলে
নিজামুদ্দিন দরগা অভিমুখে।



            পাল্কি দরগা পৌঁছানো মাত্র খাদিমদের
মধ্যে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। পাল্কি থেকে নেমে বৃদ্ধ জাফর এক হাত তুলে খাদিমদের
কুর্নিশের জবাবে আশীর্বাদ দেন। তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা দরগার ভিতর গিয়ে
দিনের প্রথম নামাজ পড়তে বসেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন হিন্দুস্থানের শেষ বাদশাহ।
পয়গম্বরের হাতে নিজের জীবন সঁপে দিয়ে যেন মুক্তি ভিক্ষা করেন জাফর। প্রধান খাদিম
বাদশাহর মাথায় চামর বোলাতে বোলাতে জাফরের অশ্রুধারা দেখে ভিতরে ভিতরে ভেঙে টুকরো
হতে থাকেন। কিন্তু তিনি এও জানেন, বাদশাহর দরগায় অবস্থান— খাদিমদের কাছে এতটুকু
নিরাপদ নয়। ইংরেজ সেনা জাফরকে খুঁজে পেলে তাদের ধরেও টানা হ্যাঁচড়া করবে। দরগায়
রক্তপাত খ্বাজাও মেনে নেবেন না। আসন্ন বিপদে তার কপালে ফুটে ওঠে জটিল ভাঁজ। জাফর
নামাজ পড়া শেষ হতেই দরগা ছেড়ে বাইরে এসে পাল্কিতে উঠে বসে হুমায়ূনের মকবরার দিকে
যেতে আদেশ দেন। কেল্লায় একরকম সিপাইদের সাথে বন্দীই ছিলেন জাফর। বহুদিন তার
সন্তানদের মুখ দেখেননি।



 



যে ক’জন ইংরেজ
সেনা বেঁচে ছিল বিদ্রোহের পর, দিল্লি শহরের দখল নিতে তাদের বেশির ভাগকেই কাজে
লাগিয়ে দিয়েছেন জেনারল উইলসন। জনা পনের ইংরেজ আর গোটা বিশেক হিন্দুস্তানি সিপাই
নিয়ে মোগল বাদশাহকে গ্রেপ্তার করার দুঃসাহস একমাত্র হাডসনেরই আছে
খবর এসেছে— সিপাই, মোগল আর জেহাদি মিলিয়ে হাজার পাঁচেক লোক জড়ো হয়ে আশ্রয়
নিয়েছে হুমায়ূনের মকবরায়। কাজটা হাসিল করা যথেষ্ট দুরূহ। তবে হডসন সাথে নিয়েছে
দুটো কামান। সেগুলো বসানো হয়েছে গরুর গাড়িতে। ক্যাপ্টেন হডসন আগে চলেছে ঘোড়ায়।
তাকে ঘিরে রয়েছে বিশ্বস্ত ইংরেজ সিপাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দুস্তানের সেনাদের
বিশ্বাস করা অসম্ভব। তারা হডসনের দলকে অনুসরণ করছে কিছুটা তফাত থেকে।



            নিজামুদ্দিনের নীলা-গুম্বদের কাছে এসে
হাত তুলে সেনাদলকে থামতে বলে হডসন
তার মাথায় এখন কূট বুদ্ধি। কামানের দায়িত্বে থাকা সিপাইদের দিকে তাকিয়ে সে
হটাত বলে, “চার্জ!”



            কামান দাগতে ভুলে গিয়ে বিস্মিত হয়ে
তাকায় গোলন্দাজেরা। কোথায় চার্জ করবে? শত্রু কোথায়? দিশেহারা গোলন্দাজদের কাছে
গিয়ে আবার নির্দেশ দেয় ক্যাপ্টেন হডসন, “আই সেইড ফায়ার! ফায়ার নাউ!”



এবার গোলন্দাজেরা অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গোলা ছোড়ে। তোপের আওয়াজে থরথর করে কাঁপে
বস্তি নিজামুদ্দিন। হডসন সেনাদের এগোতে নির্দেশ দেয় হুমায়ূন মকবরার দিকে। সে জানে
গোলার আওয়াজে মোগল আর তাদের পারিষদেরা হডসনের সৈন্য সংখ্যা পরিমাপ করতে ভুল করবে। ধীর
গতিতে এগোতে থাকে ক্যাপ্টেনের দল। এবার সে তার দলকে হাত তুলে আবার থামিয়ে দেয়,
তারপর শূন্যে গুলি ছোড়ে পিস্তল থেকে। কিন্তু মকবরার দিক থেকে কোনও আওয়াজ ভেসে আসে
না। হাডসন নিশ্চিন্ত হয়, তার পরিকল্পনা ঠিকঠাক চললে, বাদশাহকে বিনা যুদ্ধে উদ্ধার
করা সম্ভব।



আর একটু এগোতে হাডসনের নজরে এল হুমায়ূন মকবরার দরজা। তার দুপাশে জেহাদি
ঘোড়সওয়ারের দল। তাদের হাতে্র বন্দুক উদ্যত। হডস্ন চেঁচিয়ে উঠল, “নো ফায়ারিং।
বাদশাহ্‌ যদি আত্মসমর্পণ করেন, তবে তার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আর যদি একটাও গুলি
চলে, তোপ দেগে সবাইকে মেরে ফেলা হবে। একজনও অক্ষত অবস্থায় পালাতে পারবে না



রজব আলি আর মীর্জা ইলাহি বক্স এবার হডসনের হুকুমে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
এতক্ষন তারা আলাদা একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে পিছন পিছন আসছিল। তাদের দুজনকে মকবরার
ভিতরে যেতে বলে হাডসন
নিজে ঘোড়ার পিঠে একটু একটু করে এগোতে থাকে সন্তর্পণে। রজব আলি জেহাদিদের
পরিচিত। তাদের আশ্বাসে জেহাদিরা বন্দুক নামিয়ে নেয়। হডসন হুকুম দেয়, “পুট দ্য গান
ডাউন”



মুহূর্তে ইংরেজ দেহরক্ষীর দল বন্দুক নিচে করে। হাডসন এগোতে থাকে, কিন্তু দরজা
পেরিয়ে যায় না। রজব আলি আর ইলাহি বক্সের গন্তব্য পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে
হাডসন আর তার দলবল। রিসালদার সর্দার মান সিং অনেক তফাতে ছিল। হাডসনের হুকুমে সে
সামনে আসে। কিন্তু তার উদ্ধত ভঙ্গী দেখে হাডসন বেজায় চটে যায়। সে বোঝে— হিন্দুস্তানি
সিপাইদের কাউকেই আজ বিশ্বাস করা দায়। তাই সে জেহাদিদের শুনিয়ে মান সিং-কে বলে,
“বাদশাহ্‌ আর তার সাথীদের সুরক্ষার দায়িত্ব তোমার। আমি ভিতরে যাচ্ছি। দেখো, এরা
যেন কোনও গড়বড় না করে”, ইশারায় হাডসন জেহাদি অশ্বারোহীদের দেখিয়ে দেয়।



মকবরার দরজা নির্বিঘ্নে পেরোতেই হাডসনের নজরে আসে দলে দলে সিপাই, ছন্নছাড়া
মানুষ মকবরার প্রাচীরের ধারে ভিড় করে আছে
ইংরেজ সেনাদলকে মকবরায়
ঢুকতে দেখে তারা নিষ্ক্রিয় হয়েই দাঁড়িয়ে-বসে থাকে, এগোয় না। মকবরার প্রধান সিঁড়ির
বাইরে দাঁড়িয়ে হাডসন অপেক্ষা করে তার পাতা জালে বাদশাহের ধরা পড়ার মুহূর্তের জন্য।
মকবরার ভিতরে শাহি পোশাক পরা বেশ কিছু মানুষ দেখা যায়। তারা প্রবেশ পথের উঁচু
সিঁড়ির মুখে উঁকিঝুঁকি মারলেও নিচে নেমে আসার সাহস দেখাচ্ছে না। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে
হাডসন
রোদের তাপ বাড়ছে। অনেকটা পথ যেতে হবে শিকার জালে ফেলে। তবেই না পদোন্নতি!



প্রতীক্ষার অবসান হয়। সিঁড়ির উপর থেকে মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। তারপর বাদশাহের
পাল্কি চার বাহকের কাঁধে বয়ে নেমে আসে নিচে। তীক্ষ্ণ চোখে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে
চলে হাডসন
প্রবল উত্তেজনা তার বুকে। একবার যদি দলবদ্ধ মানুষেরা জাফরের গ্রেপ্তারে বাধা
দেয়, গুলি চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তবে এলেম আছে রজব আলি আর
ইলাহি বক্সের। দুজনেই পাল্কির সামনে থেকে ভিড় হটিয়ে দিয়ে নেমে আসছে দ্রুত। এবার
হাডসন নিজে ঘোড়া এগোতে থাকে মকবরার বাইরে যাবার জন্য। ইলাহি বক্স জোর গলায় জনতার
উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে, “ইংরেজ হুকুমত হিন্দুস্তানের বাদশাহ্‌ আলমপনা বাহাদুর
শাহ-কে বন্দী করেনি। তাঁকে সসম্মানে কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শান্তি বজায় রাখো
তোমরা



মকবরার বাইরে এসে রিসালদার সর্দার মান সিং-এর দিকে তাকিয়ে হাডসন হুকুম দেয়,
“পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত মকবরার দায়িত্ব তোমার উপর। এরা কেউ যেন পালিয়ে না
যায়! এদের জানিয়ে দিও, গোটা শহর সেনা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তাই আর কোনও যুদ্ধের
চেষ্টা করা বোকামোর শামিল।”



হাডসন ঘোড়া ঘুরিয়ে নিতেই রাগে মাটিতে থুতু ফেলে মান সিং। দ্বন্ধ তার মনের
ভিতরটা কুরে কুরে খায়। জাফরের পাল্কি দূরে ক্রমশ ছোট হয়ে যেতে থাকে।



লাহোর দরজা পার
হয়ে গেলেও হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ্‌র পাল্কি আগমনের সংবাদে আজ নহবতখানা থেকে
বাদ্যযন্ত্রীরা সুর তুলল না। সারা রাস্তা নিজের ফেলে আসা জীবন নিয়ে ভেবে চলেছিলেন
জাফর। এখন পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন সারি সারি ইংরেজ সৈন্য লাহোর দরজার
দুই পাশে মোতায়েন, হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল। জাফরের মন বিক্ষিপ্ত, উদাসীন। ইংরেজ
যে তাঁকে সসম্মানে দিল্লির মসনদে বসাবে না— সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। কিন্তু
জাতটার আভিজাত্য আছে। হয়ত বা শেষ মুহূর্তে ইংল্যান্ডের রানির মন টলেছে, অন্তত
জীবনের শেষ কটা বছর তারা ওকে বিরক্ত করবে না...
কিন্তু কেল্লার ভিতরে
পাল্কি প্রবেশ করতেই জাফরের সব আশা কে যেন এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দেয়। ছাত্তা বাজার
ফিরিঙ্গীদের কঠোর আঘাতে ছত্রখান। জাফর ভাবেন, এ কোন দুঃস্বপ্ন দেখছেন আজ? তিনি
চেঁচিয়ে ওঠেন, “পাল্কি থামাও!”



            জাফরের হুকুমে পাল্কি থামে না। কারা
যেন জাফরের হুঙ্কার শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে। জাফর দেখেন দিওয়ান-ই- আমে একদল ইংরেজ
সেনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সিগার ফুঁকছে। ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার চতুর্দিক নোংরা
করে রেখেছে। এ কী দৃশ্য দেখছেন জাফর! এর চাইতে বরং ইংরেজদের বুলেটের আঘাতে মরে
যাওয়া ভালো ছিল। জাফর মহলের সামনে এসে থেমে গেল পাল্কি। অবনত দৃষ্টিতে কাঁপতে
কাঁপতে বৃদ্ধ জাফর লাঠিতে ভর করে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললেন, “ইয়া
আল্লাহ্‌, এই দিন দেখার জন্য তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলে?”



            জাফরকে দেখে সামনে দাঁড়ানো সিপাইটা
মাটিতে থুতু ফেলল। জাফর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। হাভেলিতে ঢুকে তাঁর মনে হল যেন এক
ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কেউ তাঁকে টেনে হেঁচড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সযত্নে গড়ে তোলা
জাফর মহলের সমস্ত বাতিদান লুটেরারা খুলে নিয়ে গিয়েছে, কিছু ভেঙে মাটিতে মুখ থুবড়ে
পড়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে ক’দিন ধরে চলেছে দেদার লুটতরাজ।



জাফরের জন্য একটা সাধারণ কুরশি নিয়ে এল এক সৈন্য। হিংস্র গলায় বসতে হুকুম দিল
বাদশাহকে
জাফর বুঝলেন— তিনি বন্দী। কোনোদিনই দিল্লির মসনদে তাঁকে আর বসানো হবে না। ভগ্ন মন আর
শরীরে কুরশিতে নিজেকে এলিয়ে দিলেন জাফর। জল তেষ্টা পাচ্ছে। গলা তুলে হুকুম দিতে
গিয়ে নিজেকে সংযত করলেন জাফর। তাঁর আপ্ত সহায়কেরা আজ ধারে কাছে কেউ নেই। শুধু মুখ
দিয়ে বেরলো, “পানি!”



            এক অল্প বয়সী ইংরেজ সৈনিক সাধারণ
কাঁচের গ্লাসে জল এনে জাফরের সামনে বাড়িয়ে দিতে তিনি ঘেন্নায় মুখ ঘোরালেন। সৈন্যটা
কুৎসিত ভাবে হেসে উঠে বলে, “তোমার সব দামি জলের পাত্র লুঠ হয়ে গেছে বাদশাহ্‌! তুমি
এখন খাঁচায় বন্দী একটা শুয়োর ছাড়া কিছুই নও! নাও নাও জলটা খেয়ে নাও, নইলে কিছুই
জুটবে না।



            মাথাটা ঘুরে উঠল জাফরের। নোংরা জলের
পাত্র থেকে আলগোছে এক চুমুক জল খেয়ে তিনি চোখ বুজলেন। গাঢ় ঘুম নেমে আসছে তাঁর সারা
শরীর জুড়ে। মৃত্যু কি তবে আসন্ন? আজ থেকে তিনি আর বাদশাহ্‌ নন— সাধারণ এক বন্দী। জাফরের
দুই গাল দিয়ে নেমে এল জলের ধারা। তিনি অস্ফুটে বললেন—
রোজ মামুরা এ দুনিয়া মেঁ খরাবী হ্যায় জাফর, এইসি বস্তি কো তো ভিরানা
বানায়া হোতা